দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম শুধু ঋণ নিয়েই ক্ষান্ত হননি, এই ব্যাংকের টাকা নিজের মালিকানাধীন অন্য ব্যাংকে রেখেও তা লুটে নিয়েছেন। এতে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় আট হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে। ফলে ব্যাংকটি এখন চরম তারল্যসংকটে রয়েছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংকটি থেকে এস আলমের অর্থ নেওয়া শুরু হয় ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তনের পরপর। এই কারণে মালিকানা পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান আরাস্তু খান পদত্যাগ করেন। এর আগে আওয়ামী সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা এস আলম গ্রুপের কাছে তুলে দেয়। এরপর ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক নামে-বেনামে নিয়ে নেয় এস আল গ্রুপ। সেই সঙ্গে এস আলমের নিজ এলাকা চট্টগ্রামের পটিয়ার প্রায় ১০ হাজার লোককে ব্যাংকটিতে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এস আলম গ্রুপমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এরপর হাসিনা সরকারের পতনের ১৭ দিনের মাথায় ২২ আগস্ট ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে তা পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকটির প্রায় আট হাজার ৪২৫ কোটি টাকা জমা আছে। এর মধ্যে কোনো ব্যাংকে মেয়াদি আমানত হিসেবে, আবার কোনোটিতে ধার হিসেবে টাকা রাখা হয়েছে। এসব টাকার কিছু অংশ ইসলামী ব্যাংক ফেরত পেলেও বড় অংশই আটকা পড়েছে, যার পরিমাণ ৮ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা।

গত ৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংকে ১ হাজার ১৭ কোটি টাকা আটকা পড়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৩ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকে ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৫৪৭ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান আভিভা ফাইন্যান্সে আটকা পড়েছে ৬৯০ কোটি টাকা।

মেয়াদ শেষ হলেও এসব টাকা ফেরত পাচ্ছে না ইসলামী ব্যাংক। এমনকি মুনাফার টাকাও পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেগুলোকে ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ও আভিভা ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান ছিলেন স্বয়ং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও আভিভা ফাইন্যান্স আগে প্রচলিত ধারার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার। তিনি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লে ২০২১ সালে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম বদলে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের নাম পরিবর্তন করে আভিভা ফাইন্যান্স রাখা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক তখন বিশেষ বিবেচনায় ব্যাংক দুটিকে ইসলামী বানিয়ে দেয়। দুই নথিতেই সই করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তখনকার গভর্নর ফজলে কবির। এরপর ইসলামী ব্যাংক থেকে এই দুটি প্রতিষ্ঠানে টাকা নেওয়ার দ্বার খুলে যায়। এভাবে আটকে পড়েছে ইসলামী ব্যাংকের টাকা। এদিকে ব্যাংকটির অর্ধেকের বেশি টাকা এস আলম গ্রুপ একাই নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন নতুন চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, যা পরিমাণে ৮৮ হাজার কোটি টাকা।

ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর শুরুতে সরাসরি ঋণ নেয়নি; বরং গ্রুপটির মালিকানায় থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা জমা রাখে ইসলামী ব্যাংক। সেই আমানতের মেয়াদ ছিল তিন মাস। তবে বছর পার হলেও সেই টাকা ফেরত পায়নি ইসলামী ব্যাংক। এই কারণে ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আরাস্তু খানের সঙ্গে সাইফুল আলমের ‘কথা-কাটাকাটি’ হয়। এর পরই ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল পদত্যাগ করেন আরাস্তু খান।