শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানা কৌশলে সাধারণ মানুষের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কারণে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে বিশেষ নামে পরিচিতি পেয়েছেন সালমান ফজলুর রহমান বা সালমান এফ রহমান। বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প খাতের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বেক্সিমকো ও সালমান এফ রহমানের নানা অপকীর্তি।

এই এক ব্যক্তির সিন্ডিকেটেই তছনছ হয়ে গেছে দেশের পুঁজিবাজার। মুলত দেশের ইতিহাসে দুটি বড় শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতা সালমান এফ রহমান। যাঁকে সবাই একনামে চেনে ‘দরবেশ’ হিসেবে। লম্বা দাড়ি আর সাদা পোশাকের পাশাপাশি পুঁজিবাজারে তাঁর ‘কারসাজি’ পারদর্শিতার অলিখিত স্বীকৃতিই তাঁকে এই ‘দরবেশ’ পরিচিতি এনে দিয়েছে বলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধারণা। এই ‘দরবেশকাণ্ডে’ তছনছ হয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। তাঁর ক্ষমতা আর প্রভাবের থাবায় লাখো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হয়েছেন নিঃস্ব। তেমনি অনেক বিনিয়োগকারী পথের ফকিরও হয়েছেন। মুলত ২০২১-২২ সময়ে যেন সহসাই আলাদিনের চেরাগ পায় গ্রেপ্তারকৃত সালমান এফ রহমানের ফ্ল্যাগশিপ প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো লিমিটেড।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরের পর বছর ধরে সালমান এফ রহমানের নজিরবিহীন আর্থিক অনিয়ম, বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা লোপাটসহ পুঁজিবাজার জালিয়াতি অব্যাহত ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এসব তথ্য প্রকাশ্যে আসতে পারেনি। ব্যাংক ও পুঁজিবাজার থেকে জালিয়াতি, কারসাজি, প্লেসমেন্ট শেয়ার ও প্রতারণার মাধ্যমে সালমান এফ রহমান যে পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন, তা কয়েক লাখ কোটি টাকা।

গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। যুগের পর যুগ তাঁর নাম আর পুঁজিবাজারের কারসাজি সমার্থক হয়ে গেছে। দেশের ইতিহাসে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়েও বিচার হয়নি। তাঁর কালো ছায়া থেকে এখনো বেরোতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজার।

১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩১ বছরে পুঁজিবাজারে এমন কোনো বড় কেলেঙ্কারি নেই, যেখানে সালমান এফ রহমানের সম্পৃক্ততা মেলেনি। এসব কাজে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করেছেন তিনি। কারসাজির নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ভয়াবহ ধসের নেপথ্যে জুলাই থেকে ডিসেম্বরে জালিয়াতি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অভিযুক্ত সালমান এফ রহমান ও তাঁর কোম্পানি জড়িত ছিল বলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্তেও উঠে এসেছে। ব্যাংক ও পুঁজিবাজার কারসাজির অর্থ তিনি পাচারও করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে বেক্সিমকো গ্রুপের স্বত্বাধিকারী সালমান এফ রহমানসহ ২৮ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা করেছে সিআইডি। গত বুধবার অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ তথ্য জানায়।

শাইনপুকুর থেকে সুকুকে যেভাবে কারসাজি: ১৯৯৬ সালে শাইনপুকুর সিরামিক ও দোহা সিকিউরিটিজের কেলেঙ্কারিতে জড়ান তিনি। ওই সংক্রান্ত মামলার এখনো তিনি আসামি। শেয়ারবাজার কারসাজি নিয়ে ২০১১ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টেও তাঁর নাম আসে। প্রভাব খাটিয়ে বেক্সিমকো ফার্মার প্রেফারেন্স শেয়ার পাশ করিয়ে নেন তিনি। এই শেয়ারের মাধ্যমে প্রিমিয়ামসহ ৪১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। একই সময় শাইনপুকুর সিরামিকের মাধ্যমে ২৮৬ কোটি এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইলের মাধ্যমে ৬৩৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন।

এ ছাড়া জিএমজি এয়ারলাইনসের প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ৩০০ কোটি টাকা নেন তিনি। পরে ওই কম্পানি উধাও হয়ে যায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আর টাকা ফেরত দেননি। একইভাবে জিএমজি এয়ারলাইনসের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে ২২৮ কোটি ঋণ নেন তিনি। ২০১৩ সালের আইএফআইসি ব্যাংকের টাকায় নেপালের লোকসানি প্রতিষ্ঠানের ১০ টাকার শেয়ার ৭৫ টাকায় কেনেন তিনি। এই প্রক্রিয়ায় সেখানে ১২৫ কোটি টাকা পাচার করা হয়। ২০১১ সালে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে আইএফআইসি মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেন।

সৌদি যুবরাজ নামে ভুয়া এক ব্যক্তি সাজিয়ে ২০০৬ সালে রূপালী ব্যাংক কেনার নাটক সাজান দরবেশ। রূপালী ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৪০০ টাকা থেকে তিন হাজার ৪০০ টাকায় উন্নীত হয়। এই প্রক্রিয়ায় রূপালী ব্যাংকের শেয়ার থেকে ৯০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। গত তিন বছরে শেয়ারবাজার থেকে দৃশ্যমান ছয় হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি।

এর মধ্যে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড তিন হাজার কোটি, আইএফআইসি আমার বন্ড এক হাজার কোটি এবং বেক্সিমকো জিরো কুপন বন্ড ছেড়ে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন। তবে অদৃশ্য ও বেনামি মিলিয়ে তিন বছরেই ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এদিকে সুকুক বন্ড কেনার জন্য বিভিন্ন ব্যাংককে বাধ্য করা হয়।

গত কয়েক বছরে সালমান এফ রহমানের অর্থ পাচারের বিষয়টি সামনে আসে। তাঁর ব্যবসার বড় অংশই দুবাই ও সিঙ্গাপুরে। চীনের পত্রিকার হুরুন গ্লোবালের তথ্য অনুসারে, সালমান এফ রহমানের সম্পদের পরিমাণ দেড় বিলিয়ন ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় তা ১৮ হাজার কোটি টাকা।

বেক্সিমকোর শেয়ার কারসাজি: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আলোচিত বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে কারসাজি পেয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। প্রতিষ্ঠানটির তদন্তে শেয়ারটির কারসাজিতে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তাঁরা হলেন আব্দুর রউফ, ক্রিসেন্ট লিমিটেড, মোসফেকুর রহমান, মমতাজুর রহমান অ্যান্ড দেয়ার অ্যাসোসিয়েটস, জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড, মারজানা রহমান ও ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত বেক্সিমকোর শেয়ারের টার্নওভার মূল্য ছিল চার হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে ভিন্ন ভিন্ন ক্লায়েন্ট কোডের মাধ্যমে যার ৭০ শতাংশের বেশি লেনদেন করেছে এই আট বিনিয়োগকারী। তদন্তে

দেখা গেছে, গ্রুপটি যৌথভাবে রিয়ালাইজড গেইন করেছে ২১৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং আনরিয়ালাইজড গেইন করেছে ৫২৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ২০২২ সালের শেষের দিকে ডিএসইর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে জমা দেওয়া হয়। এরপর প্রতিবেদনটি শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনে আটকে যায়।

কারণ কম্পানিটি সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন এবং কারসাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত কম্পানিগুলোও তাঁরই মালিকানাধীন। কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে: ক্রিসেন্ট লিমিটেড, জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড এবং ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল।

২০২০ সালের ১৯ মার্চ বেক্সিমকোর শেয়ার দর ছিল ১১ টাকা ২০ পয়সা, যা ওই বছরের শেষ দিকে ২২ টাকায় লেনদেন হয়। তার পর থেকে শুরু হয় শেয়ারটির রেকর্ড কারসাজির গল্প। দুই মাসের মাথায় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দাম ওঠে ১০০ টাকায়। এরপর একই বছরের শেষ দিকে দাম তোলা হয় প্রায় তিন গুণ ১৯০ টাকায়। এই সময় দেখানো হয় রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা।

ঘোষণা করা হয় বড় আকারে ডিভিডেন্ড। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক তদন্তে প্রমাণিত হয়, ২০২২ সালের শুরুর দিকে বেক্সিমকোর শেয়ারের দামে কারসাজি করে আট বিনিয়োগকারীর একটি গ্রুপ ৮৪৬ কোটি টাকা রিয়ালাইজড ও আনরিয়ালাইজড গেইন করেছে।

সুকুক বন্ডের নামে বড় কারসাজি: ২০২১-২২ সময়ে যেন সহসাই আলাদিনের চেরাগ পায় গ্রেপ্তারকৃত সালমান এফ রহমানের ফ্ল্যাগশিপ প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো লিমিটেড। এই কোম্পানির মূল ব্যবসা টেক্সটাইল। আলোচ্য সময়ে, অর্থাৎ মাত্র দুই বছরেই তাদের রাজস্ব ১ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা থেকে আকাশচুম্বী হয়ে পৌঁছায় ৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকায়।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওই একই বছরে বেক্সিমকো তাদের ২০০ মেগাওয়াট তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, ৩০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং টেক্সটাইল শিল্পের আরো যন্ত্রপাতির অর্থায়নের জন্য প্রথম সুকুক বন্ড চালু করে।

বিশ্লেষকরা এখন মনে করছেন, বেক্সিমকোর কথিত এই ‘ব্যবসায়িক পারদর্শিতা’ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেন সালমান, তাতে বাড়ে কোম্পানির শেয়ারদরও। এসবই ছিল সুকুক বন্ডে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার কৌশল। ২০২১ সালের শেষে বাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সুকুকের মাধ্যমে উঠিয়ে নেন সালমান, তারপর থেকেই বেক্সিমকোর সেই অত্যাশ্চর্য পারফরম্যান্সও যেন উবে যায়। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সালমানের পুরো দুনিয়া উল্টে যাওয়ার আগে থেকেই কোম্পানিটির বিক্রি ও মুনাফায় ধস নেমেছিল।

২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি বা রাজস্ব সামান্য হ্রাসের কথা জানালেও, পরের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই তা ৬৩ শতাংশ কমার কথা জানায় বেক্সিমকো লিমিটেড। আর মুনাফায় পতন হয় ৯০ শতাংশ। ফলে যে শেয়ারদর মাত্র ২৬ মাসেই ১৪ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা ছাড়িয়েছিল– এখন তা ১১৫ টাকা ৬০ পয়সা দরে রয়েছে ফ্লোর প্রাইসের কৃত্রিম বাধার কারণে। ফ্লোর প্রাইস বা মূল্যসীমা উঠে যাওয়া মাত্রই শেয়ারদরও ধস নামার অপেক্ষায় রয়েছে।

অতিরঞ্জন ও কারসাজি: ২০২০-২২ সময়ে শেয়ারধারীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বিবৃতিতে বেক্সিমকো লিমিটেডের চেয়ারম্যান বারবার কোম্পানির রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধিসহ অন্যান্য নানান অগ্রগতির কথা বলেছেন, পিপিই’র সম্ভাবনাকে যা আরো বাড়াবে। এসবই বলা হয় বিনিয়োগকারীদের প্রলুদ্ধ করতে। তবে এসব বিবৃতিতে টেক্সটাইল, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রকৌশল বা অন্যান্য কোন খাত থেকে কত বিক্রি বা রাজস্ব আসছে তা প্রকাশ করা হয়নি। দেওয়া হয়নি কোম্পানির রপ্তানি বা স্থানীয় বিক্রির (রাজস্বের) পৃথক পরিসংখ্যান।

অথচ এসিআই লিমিটেডসহ পুঁজিবাজারের পাবলিক ট্রেডিংয়ে থাকা সব শিল্পগোষ্ঠী এসব বিবরণ প্রকাশ করে থাকে। বছরে ৪০ থেকে ৫০ কোটি ডলারের রপ্তানি করার যে দাবি সালমান এফ রহমান করেছিলেন– সেটির স্বপক্ষে কোনো স্পষ্ট ও বিস্তারিত তথ্যপ্রকাশ করেনি বেক্সিমকো লিমিটেড, যা করা হলে প্রবৃদ্ধির বানোয়াট কাহিনির আড়ালে প্রকৃতপক্ষে তারা কতটুকু লাভবান হবেন– তা বিনিয়োগকারীরা জানতে পারতেন। তবে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীরা এসব কাহিনিকে বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখেছেন।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং চার্টার্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট মো. মনিরুজ্জমান বলেন, বছরের পর বছর ধরে অনেক কোম্পানি একত্রিত করে বেক্সিমকো লিমিটেড একটি জটিল কাঠামো পেয়েছে, এবং সেগমেন্টাল ব্রেকডাউন (খাতভিত্তিক ব্যাখ্যা) ছাড়া এর রিপোর্টিং স্বচ্ছ নয়।

তিনি বলেন, আমরা, বিশ্লেষক হিসাবে, তালিকাভুক্ত সেইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দিতে শিখেছি– যাদের একই ধরনের ব্যবসার জন্য স্পন্সর-পরিচালকদের একাধিক সত্তা রয়েছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। তখন সাধারণ বিনিয়োগকারী ঠকবেন না জিতবেন সেটা নির্ভর করে উদ্যোক্তাদের মর্জির ওপর।

২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেক্সিমকো লিমিটেডের রপ্তানির কাস্টমস মূল্যায়ন ছিল মাত্র ৪০ কোটি টাকা। ফলে রপ্তানির বিষয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যানের দেওয়া ইতিবাচক বিবৃতি যেসব বিনিয়োগকারী পড়েছেন– তাঁদের ভ্রু-কুঞ্চিত হওয়ারই কথা।
গ্রুপের হাজার হাজার রপ্তানি চালানের মধ্যে মাত্র ৫৭টি ছিল বেক্সিমকো লিমিটেডের।

এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গোপনে রপ্তানি আয় নিজেদের পকেটে ভরতে সালমান ও তার সহযোগীদের মালিকানায় ছিল অন্তত ৩১টি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, যারা বিজিএমইএ’র সদস্য। এর মধ্যে ৩০টি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে সারাবো, কাশিমপুর, গাজীপুরে তাদের কারখানার ঠিকানা থেকে, যেখানে বেক্সিমকো শিল্প পার্ক অবস্থিত। গত ১৮ সেপ্টেম্বরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এধরনের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৮৩ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগে সালমান এফ রহমানসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা করেছে। তবে বেক্সিমকোর কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, আর্থিক দুরবস্থায় থাকা বিদেশি বায়ারদের কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের ১৩৫ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আটকে ছিল, তবে বায়াররা এরমধ্যেই কিস্তিতে ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে।

এবিষয়ে জানার জন্য বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বেক্সিমকো লিমিটেডের মালিকানায় আছে মূলত গ্রুপের টেক্সটাইল উইং, পোশাক উৎপাদনকারী অংশটা নয় যারা তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। আমাদের টেক্সটাইল বিভাগের রপ্তানিকে ‘ডিমড এক্সপোর্ট’ বা প্রচ্ছন্ন রপ্তানি হিসেবে গণ্য করা হয়।

তিনি বলেন, রপ্তানিখাতের সাফল্য নির্ধারণ করে দেয় বস্ত্র উৎপাদনকারীদের মতো ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে ভালোই করছিল। করোনা মহামারীর সময়েও ভালোই করেছে। তবে বিদেশি ক্রেতাদের ওপর মহামারির বড় প্রভাব ছিল, তারপরেই আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু হলে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়– তার মিলিত প্রভাব পরে বিদেশি ক্রেতাদের ওপর, যা বেক্সিমকোর ব্যবসাকেও টেনে নামায়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছিল, বাংলাদেশ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে পোশাক রপ্তানিতে ২.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। পরে জানা যায়, ইপিবি রপ্তানির তথ্য বাড়িয়ে দেখিয়েছে, ফলে বছরওয়ারি হিসেবে প্রকৃতপক্ষে রপ্তানি কিছুটা কমেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নতুন চালু হওয়া সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কয়েকশ কোটি টাকা আয়ের পরেও বেক্সিমকোর রাজস্ব ৬৩ শতাংশ ছিল তাদের বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা।

বেক্সিমকোর কোম্পানি সচিব আসাদ উল্লাহ এরজন্য করোনা মহামারি পরবর্তী সময় ও ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেন। এসব সংকট তাদের ব্যবসা কমার পেছনে দাবি করে তিনি বলেন, ‘কঠিন সময়ে প্রবৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করা হলে তাতে হিতে-বিপরীত হতে পারে।

আত্মগোপনে বেক্সিমকোর শীর্ষ কর্মকর্তারা: বেক্সটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুর রহমান, পরিচালক মাশকুরা খানম, কসমোপলিটন অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাজিয়া জামান, পরিচালক খাদিজা বিনতে আলম, কোজি অ্যাপারেলস লিমিটেড ও কাঁচপুর অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজুর রহমান খান, পরিচালক সৈয়দ তানবীর এলাহী আফেন্দী, অ্যাসেস ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু নাঈম মাহমুদ সালেহীন, পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান তানভীর,

ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমদ জালাল খান মজলিস ও পরিচালক ইমরান খান মজলিস, মিডওয়েস্ট গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাইমিনুল ইসলাম, পরিচালক কোহিনুর আবেদিন, পিয়ারলেস গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াসিউর রহমান, পরিচালক রেজিয়া আক্তার,

পিঙ্ক মেকার গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুম্মান মোহাম্মদ ফাহিম খান, পরিচালক কাজী উম্মে কুলসুম মৈত্রী, অ্যাডভেঞ্চার গার্মেন্টস লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ারুল বাশার, শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক নাসরিন আহমেদ, অ্যাপোলো অ্যাপারেলস লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ফরিদুজ্জামান, শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক কামরুন নাহার নাসিমা, প্লাটিনাম গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলিফ ইবনে জুলফিকার, পরিচালক নুসরাত হায়দার, আরবান ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল উদ্দিন ও পরিচালক শাহিদা রহমান।