দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে যথেচ্ছ লুটপাটের কারণে অনেক সবল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকখাত পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে নতুন করে পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে, অনেক দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ভালো ব্যাংকে জমা রাখছেন গ্রাহকরা। এতে কিছু ব্যাংক নগদ টাকা বা তারল্য সংকটে পড়ে আমানতকারীর চাহিদা মতো টাকা দিতে পারছে না। অন্যদিকে বহু ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য পড়ে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্টশেষে দেশের সরকারি-বেসরকারি ৪৬ ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, যার পরিমাণ এক লাখ ৯০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। অথচ সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচার করা হচ্ছে দেশে বড় ধরনের তারল্য সংকট চলছে!

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে। তারা গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। তবে এর বাইরে বেশিরভাগ ব্যাংকেই অতিরিক্ত অর্থ পড়ে আছে। ভালো ব্যাংকগুলোতে প্রতিদিনই আমানত বাড়ছে। বাজারে তারল্যের কোনো সংকট নেই। এখন দুর্বল কিছু ব্যাংকের অর্থ সহায়তা দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টিতে অর্থ দেওয়া হচ্ছে, খুব শিগগিরই এসব দুর্বল ব্যাংকের তারল্য সমস্যাও কেটে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, নানা অনিয়মের কারণে কিছু ব্যাংক সমস্যায় পড়েছে। তাদের অর্থ সহায়তা দরকার। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ দিচ্ছে না, কারণ মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। বাজারে টাকা দিলে এটা আরও বেড়ে যাবে। তাই দুর্বল বা সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংক থেকে ধার দিতে বলা হয়েছে। কারণ সবল ব্যাংকগুলোতে তারল্যের অভাব নেই। তারা অনেক টাকা অতিরিক্ত জমা করে রেখেছে। এখানে ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা দরকার, যেন ধার দিয়ে সমস্যায় না পড়ে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টার হচ্ছে, ধার পরিশোধের নিশ্চয়তা দিচ্ছে।

এ বিষয়ে ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, দেশের বেশিরভাগ ব্যাংকেই তারল্য সমস্যা নেই। বেসরকারি প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ ব্যাংকেই অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। ভালো ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক সমস্যায় আছে, তারা তারল্য সহায়তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করেছে। অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে এমন ১৪টি ব্যাংক তাদের অর্থ সহযোগিতা করছে। যার গ্যারান্টি দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আশা করছি সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর সমস্যা কিছু দিনের মধ্যেই সমাধান হয়ে যাবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় আটটি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এস আলম গ্রুপ। এগুলো হলো– ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকেরও নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল তারা। এই আটটি ব্যাংকের মধ্যে দুই-একটি ছাড়া বাকিগুলো বর্তমানে তারল্য সংকটে ভুগছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহকদের জমা টাকার সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে আমানতের একটি অংশ অর্থ বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। আর তা সংরক্ষণ করতে হয় সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড কেনার মাধ্যমে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে তাদের কাছে থাকা গ্রাহকের মোট আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ ৪ শতাংশ সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) হিসেবে রাখতে হয়। এ ছাড়া আমানতের সাড়ে ৫ শতাংশ রাখতে হয় বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে। অন্যদিকে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের বিপরীতে নগদে ৪ শতাংশ টাকা ও আমানতের ১৩ শতাংশ পরিমাণ বিল ও বন্ড বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে রাখতে হয়। এ দুটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরিমানার মুখে পড়তে হয় ব্যাংকগুলোকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শরিয়াহভিত্তিক চারটি ব্যাংক ও প্রচলিত ধারার ৪২টি ব্যাংক তার সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ বা এসএলআর হিসেবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ সংরক্ষণ করে রেখেছে। এর মধ্যে এসএলআর সংরক্ষণে শীর্ষে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। তাদের অতিরিক্ত জমা ৪৯ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত আরও চারটি ব্যাংকে অতিরিক্ত এসএলআর জমা আছে।

ব্যাংকগুলো হলো: অগ্রণী, রূপালী, জনতা ও বিডিবিএল। এসএলআর সংরক্ষণে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিদেশি মালিকানাধীন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। তাদের অতিরিক্ত জমা ১৬ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। ব্যাংক এশিয়ার অতিরিক্ত এসএলআর সংরক্ষণ আছে ৮ হাজার ৬১৯ কোটি, পূবালী ব্যাংকের ৮ হাজার ৫৩৪ কোটি ও ব্র্যাক ব্যাংকের ৮ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত এসএলআর সংরক্ষণ আছে আরও ৭টি ব্যাংকের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হোসনে আরা শিখা বলেন, ব্যাংকগুলোতে তারল্যের অভাব নেই। অধিকাংশ ব্যাংকে অর্থ পড়ে আছে। কয়েকটি ব্যাংক সমস্যায় পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টিতে ইতোমধ্যে তাদের অর্থ সহায়তা দেওয়া শুরু হয়েছে।

তিনি জানান, গত সপ্তাহে দুর্বল চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে ৯৪৫ কোটি টাকা ধার হিসেবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। দুর্বল অন্য ব্যাংকগুলোও সহায়তা পাবে। আশা করছি এতে করে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলোর সংকট কেটে যাবে। এদিকে, আর্থিক অনিয়মে দুর্বল হয়ে পড়া বেসরকারি চার বাণিজ্যিক ব্যাংককে ৯৪৫ কোটি টাকা ধার হিসেবে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে সবল পাঁচ ব্যাংক।

অর্থ সহায়তা পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো– ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তায় এ ধার দিয়েছে অতিরিক্ত তারল্য থাকা সবল পাঁচ ব্যাংক। সেগুলো হলো: সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ডাচ্-বাংলা ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক।