তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: টানা দরপতনের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজার। ফলে আস্থা ও তারল্য সংকটে হাহাকার হয়ে পড়ছে পুঁজিবাজার। এ অবস্থা থেকে কী ভাবে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবো এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মাঝে প্রশ্নের শেষ নেই। তাছাড়া টানা দরপতনের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করছে। তবে বিক্ষোভ করেও দরপতন ঠেকাতে পারছে না বিনিয়োগকারীরা। ফলে অসহায় হয়ে পড়ছেন হাজার হাজার বিনিয়োগকারীরা। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রথম চার কার্যদিবস পুঁজিবাজারে উল্লম্ফন দেখা গেলেও এরপর থেকে টানা দরপতন শুরু হয়েছে।

মুলত গত আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে থেমে থেমে দরপতন চলছে। অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাজারে ভালো ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। এতে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরুও করেছিল। কিন্তু তারপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বাজারের বড় বিনিয়োগকারীদের ক্রমাগত শাস্তির আওতায় আনার কাজে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করায় তারাও নেতিবাচক প্রবণতায় লিপ্ত হতে থাকে।

ফলে খন্দকার রাশেদ মাকুসদের নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই বাজার ধারাবাহিক পতনে আটকে যায়। প্রতিদিনই কমছে বাজার মুলধন। কোন কোন দিন বাজারে পতনের সেঞ্চুরিও হচ্ছে। যার ফলে দিশেহারা বিনিয়োগকারীদের এখন ঘুম রীতিমতো হারাম হয়ে গেছে। তাছাড়া গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতি প্রতি বছর গড়ে ছয় শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি দেখলেও পুঁজিবাজারে দেখা গেছে বিপরীত চিত্রে। বলা যায় পুঁজিবাজার হয়েছে লোকসানের বেসাতি, আকর্ষণহীন ও মন্দা থেকে আরও মন্দা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পুঁজিবাজার একটি দেশের অর্থনীতির মূল প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি। এটি বিনিয়োগকারীদের টানতে ও সমন্বয়ে ব্যর্থ হয়েছে। পোশাক প্রস্তুতকারকদের রপ্তানি আয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি রেমিট্যান্স পাওয়া পরিবারগুলোও পুঁজিবাজারে টাকা খাটাতে পারেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষস্থানীয় মার্চেন্ট ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, পুঁজিবাজার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঠিক বিপরীত আচরণ করেছে। এর পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। শেয়ার কারসাজি করা ব্যক্তিরা ছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে হতাশা ছাড়া আর কিছুই পাননি। বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ অনেকে পুঁজিবাজার ছেড়ে চলে গেছেন। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নতুন করে লগ্নি করতে দ্বিধায় পড়েছেন।

এদিকে সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের দরপতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন ডিএসইর সূচক কমলেও লেনদেন বেড়েছে। মুলত নতুন করে চার ইস্যুতে দরপতনের বৃত্তে আটকে পড়েছে পুঁজিবাজার।

প্রথমত, পুঁজিবাজারে গত ১৫ বছরে যত অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলোর বিচার করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রথম পর্যায়ে তদন্ত কমিটিকে ১২টি কোম্পানির অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন গঠনের বিষয়টি ভালভাবে নেয়নি কারসাজি চক্ররা। তবে তদন্ত কমিটি গঠন গঠনের বিষয়টি ইতিবাচক এমন উদ্যোগকে নস্যাৎ করার জন্য পুঁজিবাজারের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিহ্নিত হোতারা বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছেন। এর ফলে টানা দরপতনের মুখে পুঁজিবাজার।

দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাজারে টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট প্রকট আকার ধারন করছে। এ অবস্থায় আগে বাজার স্থিতিশীল করা নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত ছিলো। কিন্তু পুঁজিবাজার স্থিতিশীল না করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্রুত সংস্কার করার ফলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আগে বাজার ঠিক না করে কি ভাবে সংস্কার শুরু করছেন এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ফলে বাজার নেতিবাচক অবস্থায় থাকায় ছোট বড় বিনিয়োগকারীরা সাইডলাইনে রয়েছেন। যার কারণে সূচক পতনের পাশাপাশি লেনদেনও কমে গেছে বড় আকারে।

তৃতীয়ত, বেক্সিমকোর শেয়ার নিয়ে কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চার প্রতিষ্ঠান ও পাঁচ ব্যক্তিকে ৪২৮ কোটি টাকা জরিমানা করা। এতে একশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা বাজারবিমুখ হয়েছেন। এছাড়া কারসাজি ইস্যুতে এতবড় জরিমানা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে রেকর্ড। ফলে বিএসইসি বর্তমান চেয়ারম্যান সর্ম্পকে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এতে সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।

চতুর্থত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের পক্ষ থেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও নাসা গ্রুপ এবং থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেডের ( যটি মূলত নগদ লিমিটেড নামেই পরিচিত) মালিকানা বদলে নিষেধাজ্ঞা জারি। এসব গ্রুপ বা কোম্পানির তালিকাভুক্ত শেয়ারের লেনদেনে কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি না হলেও অনেকে ভুল বুঝেছেন এবং তাতে বাজারে একধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের বড় পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন সূচকের সাথে কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। তবে টাকার পরিমাণে লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, দিনশেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ৮৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৩৭৮ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৩০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ১৯০ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ২৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯৬৪ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৯২ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৮০ টির, দর কমেছে ১৫৬ টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৫৬ টির। ডিএসইতে ৩৬৮ কোটি ১৮ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের কার্যদিবস থেকে ৫২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বেশি। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৩১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১০৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ১৬৭ পয়েন্টে। সিএসইতে ২০১ টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০০ টির দর বেড়েছে, কমেছে ৮১ টির এবং ২০ টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে ৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।