দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার সম্পর্ক জোরদার করতে চায় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। একই সঙ্গে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী ঢাকা। আজ সোমবার (১৪ অক্টোবর) রাজধানীর এক হোটেলে ‘বাংলাদেশ-চীন রিলেশনস: এ ফিউচার আউটলুক’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তৃতাকালে তিনি এ কথা বলেন।

ঢাকা ও বেইজিং দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) ও সেন্টার ফর চীন স্টাডিজ (এসআইআইএস-ডিইউ) যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘চীনের কাছ থেকে আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা দরকার।’ চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার তাৎপর্য তুলে ধরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা একে বাংলাদেশের সামরিক আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেন।

চীন বাংলাদেশের নিরাপত্তা সরঞ্জামের প্রধান সরবরাহকারী উল্লেখ করে তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং ঢাকা বিশেষত সামরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে আরও সহযোগিতার প্রত্যাশা করে। তিনি বলেন, ‘বর্ধিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে, যা দেশের জন্য একটি প্রধান অগ্রাধিকার।’

এ সময় টেকসই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য সহযোগিতার আরেকটি ক্ষেত্র হিসাবে অবকাঠামো উন্নয়নের কথাও বলেন উপদেষ্টা। সময়মতো প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা অবকাঠামো উন্নয়ন ও জ্বালানি প্রকল্পে, বিশেষ করে সবুজ শক্তিতে অধিকতর সহযোগিতাকে স্বাগত জানাই।’

তিনি প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, বিশেষ করে আইসিটি সেক্টরের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে চীনের দৃশ্যমান সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় বাংলাদেশের আইসিটি খাতের উন্নয়ন আগামী বছরগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হতে পারে।’

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চলমান প্রচেষ্টায় চীনের ভূমিকা তুলে ধরে জোর দিয়ে বলেন, ‘এ সংকটের একমাত্র কার্যকর সমাধান হলো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে তাদের নিজ ভূমিতে নিরাপদ প্রত্যাবাসন। আমরা চীনের সহযোগিতার প্রশংসা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ত্রিপক্ষীয় সংলাপ (গত সাত বছরে) একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দিতে সফল হয়নি।’

উপদেষ্টা তৌহিদ আরও বলেন, ‘ঢাকা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় চীনকে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকায় দেখার অপেক্ষায় রয়েছে, যাতে রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে মিয়ানমারে ফিরে যেতে সক্ষম হয়।’

বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এ সম্পর্কের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কের দিকনির্দেশনা ঠিক করবে। বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক গতিশীলতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। আমাদের চীন থেকে অর্থপূর্ণ সহযোগিতা ও উভয় পক্ষের সহযোগিতার নতুন উপায় অন্বেষণ করা আবশ্যক।’

বিআইএসএসের চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত এ এফ এম গাউসুল আজম সরকারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশনে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ও বাংলাদেশের অর্থনীতির শ্বেতপত্র কমিটির সভাপতি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

এসআইআইএস একাডেমিক উপদেষ্টা পরিষদের পরিচালক প্রফেসর ড. ইয়াং জিমিয়ান উদ্বোধনী অধিবেশনে বিশেষ বক্তব্য দেন।

সেমিনারে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এবং এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে রয়েছে। একটি ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদার হিসেবে, চীন দৃঢ়ভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে রাষ্ট্রীয় সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়া ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নের প্রচেষ্টা সমর্থন করে।’

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক কথোপকথনের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নে বাংলাদেশের জনগণের দৃঢ় সমর্থন ও প্রতিশ্রুতি দেখতে পেয়েছি। এ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, আমাদের দুই দেশের গভীর সহযোগিতার জন্য এখন উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছে।’

চীনা রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘ব্রিকস মেকানিজমের অংশীদার দেশ ও আসিয়ানের সঙ্গে সংলাপের অংশীদার হতে চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করছে।’

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চীন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে অবদান রাখতে এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে জাতিসংঘ ও অন্যান্য বহুপক্ষীয় কাঠামোর মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা জোরদার করতে ইচ্ছুক।’

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তাঁর বক্তব্যে চীনা কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চলে (সিইআইজেড) বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘কর্ণফুলী টানেলকে অর্থনৈতিকভাবে টেকসই করার জন্য এ ধরনের বিনিয়োগ অপরিহার্য এবং বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে বর্ধিত অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে এর ভূমিকা রয়েছে।’

সেমিনারে তিনটি কার্য অধিবেশন ছিল। ‘আঞ্চলিক পরিবর্তনশীলতায় বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক ভূদৃশ্যের প্রভাব’ শীর্ষক প্রথম কার্য অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান। ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কার ও প্রবণতা’ শীর্ষক দ্বিতীয় কার্য অধিবেশনটি পরিচালনা করেন একাডেমি অব কনটেমপোরারি চীন অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড স্টাডিজের অ্যাসোসিয়েট রিসার্চ ফেলো ড. ঝাং জিয়ান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন ‘চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতা জোরদার এবং ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতা অংশীদারত্বের অগ্রগতি’ শীর্ষক তৃতীয় কার্য অধিবেশন পরিচালনা করেন।

বিভিন্ন অধিবেশনে বক্তারা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সহযোগিতা বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক হচ্ছে সম্পর্কের ভিত্তি। বক্তারা বাংলাদেশের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে চীনের মর্যাদার প্রশংসা করেন এবং বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে চীনের গৃহীত বেশ কয়েকটি মূল উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।

বিষয়: