বিএসসিপিএলসি আয় মুনাফায় ধস, এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি
শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানি বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল পিএলসি (বিএসসিপিএলসি) বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে ব্যবসা হারাচ্ছে। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির আয় ও মুনাফায় ধস দেখা দিয়েছে। গত হিসাববছর তুলনায় কোম্পানিটিরি মুনাফা ১১৩ কোটি টাকা কমেছে। এজন্য কোম্পানিটি সমাপ্ত অর্থবছরে ৪০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। তবে কোম্পানিটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৫১ শতঅংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল।
কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, গত হিসাববছর সাবমেরিন কেবলের আয় (রেভেনিউ) কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯৮ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ হিসাববছর ছিল ৫১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে ১১৩ কোটি টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় ছিল ৪৪১ কোটি টাকা। আয় কমে যাওয়ায় গত হিসাববছরে বিএসসিপিএলসির মুনাফা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরে কোম্পানিটি মুনাফা করেছিল ২৭৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে মুনাফা কমেছে ৯৭ কোটি টাকা।
এদিকে, লভ্যাংশ কম দেওয়ার সিদ্ধান্তে কমেছে কোম্পানিটির শেয়ারদর। বিএসসিপিএলসি বলছে, মূলত আন্তর্জাতিক সাবমেরিন কেবল ক্যাপাসিটি (আইপিএলসি) ভাড়া ও আইপি ট্রানজিট সার্ভিস থেকে আয় কমে গেছে। পাশাপাশি সাবমেরিন কেবল পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা খাতে খরচ বেড়ে গেছে। সার্বিক পরিস্থিতিই মুনাফা কমার জন্য দায়ী।
তথ্য বলছে, বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়া হয়। এ কারণে ইন্টারনেট সেবার একক কর্তৃত্ব হারিয়েছে বিএসসিপিএলসি। একসময় একক নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বর্তমানে দেশের চাহিদার অর্ধেকেরও কম ব্যান্ডউইথ বিক্রি করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। বাকি অর্ধেকের বেশি সরবরাহ করে বেসরকারি ৭ কোম্পানি। এ কারণে তাদের আয় ও মুনাফা কমে যাচ্ছে।
দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির। এরপরও বেসরকারি খাতের দ্রুত বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে সাবমেরিন কেবল ব্যবসা হারাচ্ছে। আর সামিটের মতো বড় বড় কোম্পানি ব্যবসা দখল করে নিচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে বিএসসিপিএলসির প্রায় ৫ হাজার জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ। সরকার হারাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব।
দেশে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ আমদানি করে ইন্টারনেট সেবা দিয়ে আসছিল বিএসসিপিএলসি। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল টেরিসট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) লাইসেন্স নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ আমদানি করে। কোনো কারণে সাবমেরিন কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু এর বিকল্প হিসেবে সামিটসহ ৭ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আইটিসি লাইসেন্স দেওয়া হলেও বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানিগুলোই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের ইন্টারনেট ব্যবসা।
এমনকি লভ্যাংশ প্রদানেও বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসসিপিএলসিকেও সামিটের ওপর নির্ভরশীল করা হয়েছে। এই নির্ভরশীলতা কমাতে গত বছর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে ব্যান্ডউইডথ ব্যবহারের অনুপাত ৭০:৩০ নির্ধারণের অনুরোধ জানায় বিএসপিএলসি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এ বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সাবমেরিন কেবল পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বিএসসিপিএলসি ব্যান্ডউইডথ বিক্রির আয় থেকে পরিশোধ করে। বেসরকারি কোম্পানির সুবিধা দেওয়ার কারণ বিক্রি কমে গেলে পরিচালন ব্যয় উঠে আসাই চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। এ ছাড়া ব্যবসা ক্রমাগত হারাতে থাকলে কোম্পানিটির শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পুঁজিবাজারের লাভজনক প্রতিষ্ঠানটির লভ্যাংশ প্রদানেরও সক্ষমতা আরও কমে যাবে।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলসে (বিএসসি-পিএলসি) চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক উভয় পদেই পরিবর্তন হয়েছে ছয়বার। কোম্পানির বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ পেয়েছেন ২০ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। ব্যান্ডউইথের দাম কমেছে কয়েক দফা। চালু হয়েছে সিমিউই-৫ সাবমেরিন কেবল। শুরু হয়েছে সিমিউই-৬-এর কাজ। এমন অনেক পরিবর্তনই এসেছে বিএসসিপিএলসিতে। শুধু পরিবর্তন আসেনি কোম্পানির নিজস্ব কর্মকর্তাদের ভাগ্যে এবং কোম্পানির উন্নতিতে। কোম্পানির আয়-উন্নতি না হলেও নানা কৌশলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে তাদের পকেট ভারী করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএসসিপিএলসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকলেও কোম্পানির উন্নতির দিকে তাদের নজর নেই। কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় কোম্পানিটির ব্যান্ডউইথ বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে। সম্প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠানটির আয় ও মুনাফায় ধস দেখা দিয়েছে।
এদিকে ব্যান্ডউইথ বিক্রি বাবদ বিভিন্ন কোম্পানির কাছে চলতি অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া রয়েছে প্রায় ২৪৫ কোটি টাকা। যদিও আগের অর্থবছরগুলোতে বকেয়ার পরিমাণ ছিল আরও বেশি। জানা গেছে, গত কয়েক অর্থবছরের হিসাবে সবচেয়ে বেশি বকেয়া বেড়েছে ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে। ২০২১-২২ সালে কোম্পানির বকেয়া ছিল ৩০৭ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮২ কোটি টাকা।
বকেয়া আদায় না বাড়লেও নিয়মিতই বকেয়া আদায়ের সভা হয়। এসব সভায় বকেয়া আদায় না বাড়লেও সম্মানীর টাকায় পকেট ভরছেন কর্মকর্তারা। জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৮০টির বেশি সভা করেছে বকেয়া আদায় কমিটি। এজন্য ২০ লাখ টাকার বেশি সম্মানী নিয়েছেন কমিটির সদস্যরা। অন্যদিকে, কর্মকর্তাদের পরিচিত ব্যাংকে বিনিয়োগ করায় কোম্পানিটির বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংককে বিনিয়োগ করায় টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উচ্চ মুনাফা হারে বিনিয়োগের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কম মুনাফা হারে নিজস্ব পরিচিত ব্যাংককে বিনিয়োগ করায় কোম্পানির ক্ষতি হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা।
কোম্পানির ব্যাংকিং ও ইনভেস্টমেন্ট পলিসি না মেনে নিজস্ব স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। শুধু এস আলমের ঝুঁকিপূর্ণ তিন ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো হলো সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ব্যাংকগুলো থেকে টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ ছাড়া ব্যক্তি স্বার্থে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির কাছে স্পর্শকাতর তথ্য পাচারের অভিযোগ উঠেছে বিএসসিপিএলসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তথ্য পাচারের বিপরীতে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তারা। বিএসসিপিএলসির ও বিটিআরসি তথ্য পাচারের অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এবং বর্তমান এমডির বিরুদ্ধে।
পদোন্নতি মেলেনি কোম্পানির নিজস্ব কর্মকর্তাদের: বছরের পর বছর ধরে পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ, যোগ্যতা ও পর্যাপ্ত পদ ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও মেলেনি পদোন্নতি। বিএসসিপিএলসির বিভিন্ন গ্রেডের সহকারী ব্যবস্থাপক থেকে উপমহাব্যবস্থাপক অধিকাংশ কর্মকর্তার কারোরই মেলেনি পদোন্নতি। বরং বছরের পর বছর একই পদে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে বেতন বৃদ্ধি।
এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। ১৬ বছর ধরে চলে আসা এই বৈষম্যের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের হাতে এসেছে বেশকিছু নথিপত্র। নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য একের পর এক সভা করে গেছে পদোন্নতি কমিটি। কিন্তু পদোন্নতি দেওয়া না হলেও সভার নামে নেওয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা সম্মানী। এসব ফলশূন্য সভায় আপ্যায়ন ব্যয়ও হয়েছে লাখ টাকার বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি স্বায়ত্তশাসিত কোম্পানিটির কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য পরিচালনা পর্ষদ থেকে পাঁচ সদস্যের পদোন্নতি কমিটি করে দেওয়া হয়। এই কমিটির প্রত্যেক সদস্য একটি সভা করলেই সম্মানী পান ১২ হাজার টাকা। প্রতিটি সভার পেছনে সম্মানী ও আপ্যায়ন বাবদ কোম্পানির খরচ প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। গত ৫ বছরে পদোন্নতি কমিটি একের পর এক এমন সভা করে নিয়েছে ১০ লাখ টাকার বেশি।
সবশেষ দুটি সভার নোটিশ পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত মাসে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি সভা করে পদোন্নতি কমিটি। এজন্য পাঁচ সদস্য নিয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা সম্মানী। আপ্যায়নে খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু পদোন্নতি দেওয়া হয়নি একজন কর্মকর্তাকেও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটির বিভিন্ন গ্রেডে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেছেন—এমন কর্মকর্তার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩০ জন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে কর্মকর্তা পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়েছেন মাত্র আটজন। তার মধ্যে সাতজনই পদোন্নতি পেয়েছেন উপব্যবস্থাপক থেকে ব্যবস্থাপক পদে। একজন পেয়েছেন ব্যবস্থাপক থেকে উপমহাব্যবস্থাপক পদে। আজ পর্যন্ত এ কোম্পানির নিজস্ব কোনো কর্মকর্তা মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি পাননি।
পদোন্নতি বঞ্চিত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত রয়েছেন। পদ ফাঁকা থাকলেও তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। পদোন্নতি না পাওয়ায় ১৬ বছর ধরে অনেকে একই পদে কর্মরত রয়েছেন। মূলত টেলিকম ক্যাডারের কর্মকর্তারা উচ্চপদগুলো নিজেদের কাছে রাখতে এমন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি না দেওয়ার কারণ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বেশকিছু অনিয়মের তথ্য। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানির নিজস্ব কর্মকর্তাদের পদোন্নতি না দেওয়া হলেও অনিয়ম করে দেওয়া হয়েছে জ্যেষ্ঠ পর্যায়ে নতুন কর্মকর্তাদের নিয়োগ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালে কুয়াকাটা ল্যান্ডিং স্টেশনে ডিজিএম পদে নিয়োগ পেয়েছেন তারিকুল ইসলাম। যোগ্যতার শর্ত শিথিল করে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার পদে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভিজ্ঞতায় তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
একইভাবে কক্সবাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে ২০২২ সালে সুরচিত বড়ুয়াকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সুরচিত বড়ুয়া ২০১৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিসি) থেকে আইএমবিএ ডিগ্রি নেন। এই ডিগ্রি দিয়ে তিনি ডিজিএম পদে নিয়োগ পান। যদিও ইউআইটিসির আইএমবিএ ডিগ্রি ইউজিসির স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নয়। অর্থাৎ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নয় এমন ডিগ্রি নিয়ে সুরচিত বড়ুয়া ডিজিএম পদে নিয়োগ পেয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা এবং ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও শর্ত শিথিল করে তাদের নিয়োগ দেওয়ার পেছনে ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। যোগ্যতার শর্ত শিথিল করে তাদের নিয়োগ দেন সাবেক এমডি মশিউর রহমান ও বর্তমান এমডি মির্জা কামাল আহম্মদ।
টেলিকম ক্যাডারদের আধিপত্য: বর্তমানে বিএসসিপিএলসির মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও অর্থ), মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং ও সেলস) এবং মহাব্যবস্থাপক (চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) পদে টেলিকম ক্যাডার সার্ভিস থেকে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা যুক্ত আছেন। কোম্পানির চারটি জিএম পদের মধ্যে তিনটি দখলে রয়েছে এ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। কোম্পানির জিএম পদে পদোন্নতি দেওয়া হলে টেলিকম ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসার সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে, এটি কোম্পানির নিজস্ব কর্মকর্তাদের পদোন্নতি আটকে রাখার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
কোম্পানি ভাতা নিয়ে চলছে অনিয়ম: ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন কোম্পানিগুলোতে প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের জন্য ২০২২ সালে ‘বিশেষ ভাতা’ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেখানে প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের জন্য গ্রেডের ভিত্তিতে মাসিক সর্বোচ্চ ৬ হাজার ১১ টাকা থেকে ১১ হাজার ৮৫০ টাকা ভাতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এ হার নির্ধারণ করে দেওয়ায় প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের ভাতা কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। এ কারণে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ম্যানেজ করে আগের ‘কোম্পানি ভাতা’ চালু করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়ে বোর্ড সভা থেকে সুপারিশ করা হয়।
তবে ‘কোম্পানি ভাতা’ চালু রাখতে বিএসসিপিএলসির বোর্ড সভার সেই সুপারিশ অনুমোদন করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়।
একই নির্দেশনা রয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও। প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ বিভাগের নির্দেশনা মেনে ভাতা নিলেও বিএসসিপিএলসি সেই নির্দেশনা মানছে না। অর্থ বিভাগের নির্দেশনা অমান্য করে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা বোর্ডের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে গত দুই বছরে কয়েক কোটি টাকা ভাতা হিসেবে নিয়েছেন। যদিও এই ভাতার পরিমাণ হওয়ার কথা কয়েক লাখ টাকা। এই ভাতার অনুমোদন না থাকার পরও তা কার্যকর রাখার মাধ্যমে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা কোম্পানির বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও পদোন্নতিসহ চাকরিতে পুনর্বহাল: তদন্তে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৭ সালে বর্তমান মহাব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জাহাঙ্গীর আলমকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এর আগে ২০১২ সালেও তাকে একবার চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। দুর্নীতির দায়ে দ্বিতীয়বার চাকরি হারানোর পর জাহাঙ্গীর আলম হাইকোর্টের রায়ে ২০২২ সালে প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতিপূরণসহ চাকরি ফেরত পান।
কিন্তু দুর্নীতি অভিযোগে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তার বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো রিভিউ বা লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময় মির্জা কামাল আহম্মদ মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও অর্থ) পদের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও এ রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করেননি। এমনকি দুর্নীতির দায়ে চাকরি হারানো কর্মকর্তাকে পদোন্নতিসহ চাকরিতে পুনর্বহালে বর্তমান এমডি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
আরও অভিযোগ রয়েছে, মির্জা কামাল আহম্মদ নেত্রকোনা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাজ্জাদুল হাসানের মধ্যস্থতায় জাহাঙ্গীর আলমকে পুনর্বাসনের বিষয়ে ভূমিকা রাখেন। জাহাঙ্গীর আলমকে শুধু পুনর্বাসনই করা হয়নি, তাকে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে, যেখানে তিনি কোম্পানির সব ক্রয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন।
জানা গেছে, জাহাঙ্গীর আলম বিএসসিপিএলসির ইতিহাসে একমাত্র কর্মকর্তা, যিনি দুর্নীতির দায়ে দুইবার চাকরি হারিয়েছেন। তার নিয়োগে পদোন্নতি কমিটির কোনো সুপারিশও ছিল না এবং তিনি একাধিকবার বরখাস্ত হয়েছেন। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক কারণে দুর্নীতি প্রমাণ হলেও তাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের হাতে আসা একটি পুলিশি প্রতিবেদনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি উঠে এসেছে। পুলিশি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগের একজন কর্মী এবং তার পরিবারও আওয়ামী লীগ সমর্থক।
এমডির (অতিরিক্ত দায়িত্ব) বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ: বর্তমান এমডির বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। টেলিকম ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসা বিএসসিপিএলসির বর্তমান এমডি (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মির্জা কামাল আহম্মদ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০১৬ সালে টেলিকম ক্যাডার থেকে প্রেষণে উপমহাব্যবস্থাপক হিসেবে বিএসসিপিএলসিতে যোগ দেন। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তিনি মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
জানা গেছে, সিনিয়র কর্মকর্তাদের পেছনে ফেলে মাত্র ৮ বছরের মধ্যে বিএসসিপিএলসির শীর্ষ পদে পৌঁছেছেন। তিনি একাই বর্তমানে কোম্পানির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
বর্তমানে তিনি সিমিউই-৬ প্রকল্পের পরিচালক পদে রয়েছেন, যা তার মূল দায়িত্ব। পাশাপাশি মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও অর্থ) এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করছেন মির্জা কামাল। অন্যদিকে, বিএসসিপিএলসিতে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০০৯ সালে কোম্পানিতে যোগদান করা অনেক কর্মকর্তা গত ১৬ বছরে একটিও পদোন্নতি পাননি, একই পদে স্থবির হয়ে রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, মির্জা কামাল আহম্মদ বিএসসিপিএলসির ডিজিএম পদে থাকাকালীন থেকেই কোম্পানির কর্মকর্তাদের পদোন্নতি আটকাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ২০১৬ সালে একবার পদোন্নতির বিষয়টি অনুমোদনের পর্যায়ে ছিল। মির্জা কামাল সেটি ঠেকিয়ে দেন। এ ছাড়া গত বছরের শুরুর দিকে পরিচালনা পর্ষদে একটি সুপারিশ করা হয়েছিল, যেখানে কোম্পানির উপমহাব্যবস্থাপকদের মধ্যে একজনকে মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। মির্জা কামাল এই গুরুত্বপূর্ণ পদটি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পর্ষদ সভায় সুপারিশটি উত্থাপন করা থেকে বিরত রাখেন।
অভিযোগ রয়েছে, মহাব্যবস্থাপক পদে থেকে মির্জা কামাল কোম্পানির আর্থিক ও প্রশাসনিক সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন। একই সঙ্গে এফডিআর বাণিজ্য ও কোম্পানির বিপুল পরিমাণ বকেয়ার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। জানা গেছে, মির্জা কামাল যখন বকেয়া আদায় কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন, তখন দুই বছরে কোম্পানির বকেয়া বাড়ে ১৬০ কোটি টাকা।
অভিযোগ অস্বীকার করে বিএসসিপিএলসির এমডি (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মির্জা কামাল আহম্মদ বলেন, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বা নিয়োগ সব বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়। ভাতার বিষয়ে তিনি বলেন, কোম্পানি আইনের আওতায় বেতনভাতা বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নেওয়া হচ্ছে। বকেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি চেষ্টা করেছি, বারবার রিপোর্ট দিয়েছি, বকেয়া করেছে কোম্পানি, এখানে তো আমার দায় নেই। তিনি আরও বলেন, ইনভেস্টমেন্ট পলিসি অনুযায়ী ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হয়েছে। কোনো কিছুই আমার হাতে নেই, আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অমূলক।