আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। ১৫ বছর টানা ক্ষমতায় থাকা দলটির সাংগঠনিক শক্তি যে আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, সেটি এখন ধারাবাহিক প্রকাশ পাচ্ছে।

মুলত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামীলীগ চার নেতা পরিচালনা করতেন। এই চার নেতা হলেন মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী, সাধারণ সম্পাদক, হুমায়ন কবির, দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন, ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের রাজনীতিতেই এখন অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েছে আওয়ামী লীগ। প্রায় দেড় দশক টানা ক্ষমতায় থাকা দলটির সাংগঠনিক শক্তি যে আগে থেকেই ভেতরে-ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, সেটা এখন আবার উঠে আসছে দলের ভেতর থেকেই। নেতাকর্মীদের দাবি, এই চার নেতার দাপটে দক্ষিন আওয়ামীলীগের সকল অপকর্ম বিস্তার ছিলো। যার ফলে মাঠের তথ্য এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের থেকে দূরে সরে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

আবু আহমেদ মন্নাফী। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার ছেলে আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত এই বাবা-ছেলে ছিলেন ঢাকা মহনগর দক্ষিণের কিং। দলের পদবাণিজ্য, ক্যাসিনো পরিচালনা, মাদক কারবার, জমি দখল, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা।

তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপের কাছে একেবারে অসহায় ছিল এলাকাবাসী। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা অনেক প্রভাবশালী নেতা, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাও। পরিস্থিতি এমন ছিল যেন তাদের তাদের কথা ছাড়া মহানগর দক্ষিণের একটি গাছের পাতাও নড়ত না। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দলের অন্য নেতাদের মতো গা ঢাকা দিয়েছেন মন্নাফী ও তার ছেলে গৌরবও। তারা দেশে, নাকি বিদেশে পালিয়েছেন সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও তার আত্মীয়স্বজনরাও।

ঢাকা দক্ষিণের বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদবাণিজ্যের মাধ্যমে আবু আহমেদ মন্নাফী ও তার ছেলে গৌরব কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমন অভিযোগ থাকার পরও মন্নাফীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। উপরন্তু তার এ পদবাণিজ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে বাবা-ছেলে অপকর্মে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের আওতায় ক্যাসিনোকাণ্ডসহ টেন্ডারবাজি, ফুটপাথ থেকে শুরু করে নানা ধরনের চাঁদাবাজি, জমি দখল, বাড়ি দখল, প্রতিপক্ষের ওপর আঘাত, সরকারি জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণ, মাদক বিক্রিতে সহায়তা, সন্ত্রাসী লালনসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে এ দুজনের বিরুদ্ধে।

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট সম্মেলন হলেও গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কমিটি দেননি মন্নাফী। এর আগে প্রস্তাবিত কমিটিতে দলের দুর্দিনের ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে চিহ্নিত অপরাধী, মাদক কারবারি, মামলার আসামি, হাইব্রিড ও বিতর্কিতদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি। এ বিষয়ে থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট নেতারা একাধিক তথ্য প্রমাণসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ দেন। পাশাপাশি দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছেও লিখিত অভিযোগপত্র জমা দেন তারা। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তির জোরে বাপ-ছেলের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগের তদন্তই হয়নি।

অন্যদিকে কমিটি না দিয়ে উল্টো পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত হন মন্নাফী। ওই সময় কেন্দ্রের কাছে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সভাপতি হিসেবে ছেলে গৌরবের নাম প্রস্তাব করেন মন্নাফী। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে গৌরবকে দলীয় সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া দলের গুরুত্বপূর্ণ থানা ও ইউনিটগুলোতে মন্নাফীর ছেলে নিজস্ব বলয় গড়ে তোলেন। তারই নিয়ন্ত্রণে ছিল দলীয় সব কর্মকাণ্ড। পাশাপাশি অপরাধ জগৎও নিয়ন্ত্রণ করতেন বাপ-ছেলে। এসব বিষয় উল্লেখ করে একপর্যায়ে প্রস্তাবিত কমিটির অনুমোদন না দিয়ে বিতর্কিতদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চান ত্যাগী নেতারা।

রাজধানীর কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের অনুমতির জন্য গত বছর আগস্টে ওই ইউনিটের নেতারা গিয়েছিলেন আবু আহমেদ মন্নাফীর কাছে। তিনি এ বিষয়ে গৌরবের সঙ্গে আলোচনা করতে বলেন। এরপর নেতারা তার সঙ্গে কথা বলতে যান। সম্মেলনের মাধ্যমে পদ পাওয়ার আশায় তখন গৌরবকে ২০ লাখ টাকা দেন কদমতলী থানা আওয়ামী লীগ নেতারা।

এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ময়লা সংগ্রহবাবদ অবৈধ চাঁদা আদায়সহ কাপ্তান বাজারের মুরগিপট্টি থেকে মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে গৌরবের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গেও একাধিকবার বিরোধে জড়িয়েছেন তিনি। তবে মন্নাফীর ছেলে হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দল।

অন্যদিকে পুরান ঢাকার বিবির বাগিচা এলাকার ‘আতঙ্ক’ জুয়েল বাহিনীসহ তিনটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে গৌরবের বিরুদ্ধে। এমনকি গৌরবের নির্দেশে রাস্তা হিসেবে রেকর্ড হওয়া জমিও দুর্নীতির মাধ্যমে দোকানের জন্য বরাদ্দ দেয় ডিএসসিসি। এ বিষয়ে ডিএসসিসির সাবেক প্রশাসক খলিলুর রহমান, সাবেক সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ দিদারুল আলম, গৌরবসহ ৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এ ছাড়া গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবনেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণের দফতর থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে কর্মসূচি প্রণয়ন হতো না বলে অভিযোগ করেন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। সবকিছুই হতো কাপ্তানবাজরে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিস থেকে। মধ্যরাত পর্যন্ত ওই অফিসে চলত বিভিন্ন দেনদরবার। মহানগর দক্ষিণের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ওয়ারী, সূত্রাপুর, কোতোয়ালির একাংশ, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মতিঝিল ও শাহজাহানপুর থানার দলীয় কার্যক্রম চলত এ অফিস ঘিরেই। তাদের বলয়ের বাইরে গেলে চলত নির্যাতন।

এ ছাড়া নবাবপুর মোড় থেকে হোটেল সুপার স্টার পর্যন্ত প্রতি রাতে অবৈধভাবে মুরগির পাইকারি দোকান বসাতেন গৌরব। প্রতি রাতে গৌরবের অন্তত ৭০ জন অনুসারী মুরগিবাহী শত শত গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করত। এতে নেতৃত্ব দিতেন মো. রাসেল নামে এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে গৌরবের চাচাতো ভাই হিসেবে পরিচয় দিতেন।

ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মুরগি বিক্রেতার গাড়ি থেকে ১৫০০ টাকা এবং ক্রেতার গাড়ি থেকে ১০০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হতো প্রতিদিন। প্রতি রাতে চাঁদা উঠত কয়েক লাখ টাকা। এ ছাড়া গুলিস্তান, ওয়ারী, দয়াগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকার ফুটপাথ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবহনে চাঁদার ভাগও পেতেন গৌরব। মেডি নামে এক ব্যক্তি তার আর্থিক বিষয় দেখভাল করতেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, আবু আহমেদ মন্নাফী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও তার ছেলেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। দলের ভার অলিখিতভাবে গৌরবকেই দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। থানা আর ওয়ার্ডের পদধারী নেতাদের না জানিয়েই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অনুসারীরা কর্মসূচি পালন করতেন।

এর সামনের সারিতে থাকতেন চিহ্নিত চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, মাদক মামলার আসামিসহ বিতর্কিত ব্যক্তিরা। সার্চ কমিটির মাধ্যমে দলের সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমে গৌরবের অনুসারীরা ভিন্ন দলের কর্মী থেকে শুরু করে মামলার আসামি ও বিতর্কিতদের দলে ঢুকিয়ে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতেন। তারাই দখল, চাঁদাবাজি, ভবন নিয়ন্ত্রণ, পরিবহনের চাঁদাবাজি ও মাদকের নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সব ধরনের অপকর্ম করতেন। এসব কাজে পূর্ণ সমর্থন ছিল মন্নাফীর। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, পদধারীরাও অপদস্থ হওয়ার ভয়ে এসব নিয়ে তখন মুখ খোলেননি।

আবু আহমেদ মন্নাফী নগর দক্ষিণের সহসভাপতি থাকার সময় দলীয় কোনো কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না থাকা ছেলে গৌরবকে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক বানিয়েছিলেন। এরপর গৌরব কাউন্সিলর হলে এলাকার রাজনীতির পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। তার সম্মতি ছাড়া কোনো ইউনিট বা ওয়ার্ডের কমিটিতে পদ পাওয়া যেত না। তার বলয়ে থাকা লোকজন বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত ছিল। আবু আহমেদ মন্নাফী ও তার ছেলে আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব আত্মগোপনে থাকায় তাদের এসব বিষয়ে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাদের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তারা কোনো সাড়া দেননি।

রিয়াজের অপকর্মের ফিরিস্তি: শুধু ফেসবুকে একটি পোস্টে লাইক দেওয়ায় শাস্তিস্বরূপ দুই মাসের জন্য সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয় এক শিক্ষককে। এ ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে। কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ক্ষমতার প্রভাবে সিনিয়র শিক্ষক নুসরাত জাহানকে এই শাস্তি দেন। অথচ এই সভাপতি পড়াশোনা করেছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিয়মবহির্ভূতভাবে টাকার বিনিময় ১০ শিক্ষককে নিয়োগ, ১৫ শিক্ষককে পদায়ন ও স্থায়ীকরণ করেছেন তিনি। নিজের বলয়ের দুই শিক্ষকের ছয় মাসে দুবার বেতন বৃদ্ধি করেছেন। আর এসব করেছেন এ কলেজের গভর্নিং বডির সাবেক সভাপতি মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ।

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও ক্ষমতার প্রভাবে রাজধানীর উইমেন্স কলেজ, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হোমিওপ্যাথি কলেজ, শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ এ চারটি কলেজের গভর্নিং বডির দায়িত্বে ছিলেন। প্রতিটি কলেজ থেকে কোটি কোটি টাকা লুট করেছেন তিনি। এর মধ্যে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে উইমেন্স কলেজের গভর্নিং বডির পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। একইভাবে আর্থিক অনিয়মের কারণে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতির পদ ছাড়েন। একই কলেজ থেকে ৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় থেকে ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।

শিক্ষকদের অভিযোগ, ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি হন রিয়াজ। এরপর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শনির ছায়া পড়ে। শিক্ষকদের বিভাজন ও একের পর এক প্রিন্সিপাল দায়িত্ব থেকে সরে যান। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিজের জন্য কলেজে শিক্ষকদের রেস্টরুম বরাদ্দ নেন সভাপতির নামে। পরবর্তী সময়ে এটা হয় আড্ডাখানা ও গোপন কক্ষ। গভীর রাত পর্যন্ত ওই রুমে অবস্থান করতেন। সেখানে বসে রাজনীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামলা দিতেন।

পুরো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিসিটিভি মনিটরিং করতেন নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে। শিক্ষকদের সাজগোজ ও পোশাক নিয়েও কথা বলতেন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছের লোক বলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হলেও কেউ মুখ খুলতেন না। তার মতের বিরুদ্ধে গেলেই কথায় কথায় নোটিশ দিয়ে হেনস্তা করা হতো। নারী শিক্ষকদের অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এমন কিছু স্ক্রিনশট আছে কালবেলার কাছে।

জানা গেছে, রিয়াজ গভর্নিং বডির সভাপতি পদ পেয়েই তৎকালীন প্রিন্সিপাল মো. মনোয়ার হোসেনকে সরিয়ে দেন। এরপর ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে নেন। নিয়ম না মেনে ১০ জন শিক্ষককে চাকরি দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, মাত্র ছয় মাসে দুবার ঘনিষ্ঠ দুজন শিক্ষককের বেতন বাড়ান। প্রতি বছর প্রতিষ্ঠান অডিট করানোর নিয়ম থাকলেও তা করেননি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। শুধু অর্থ আত্মসাৎ নয়, শিক্ষকদের সঙ্গে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে শিক্ষকরা আবেদন করে প্রতিকার চান।

এরপর তার অপকর্মের ফিরিস্তি সামনে এলে ২০২৩ সালে সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের পদও হারান তিনি। এরপর তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির প্রভাব খাটিয়ে পুরো তদন্ত রিয়াজ পক্ষে নেন। তার ক্ষমতার দাপটে এতদিন কেউ মুখ খোলেননি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়সহ অন্যান্য কলেজের শিক্ষকরা। রিয়াজের অপকর্ম ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে ফের তদন্ত চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালায়, শিক্ষা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করেছেন তারা। জানা গেছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন রিয়াজ।

অভিযোগকারী শিক্ষকরা বলেন, রিয়াজের মতের বিরুদ্ধে গেলেই প্রিন্সিপাল ও শিক্ষকদের নানা অভিযোগ তুলে সাময়িক অব্যাহতি দিতেন। সাবেক প্রিন্সিপাল মনোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। আমি সততা ও সম্মানের সঙ্গে চাকরি করেছি। আমি চলে আসার পর ফান্ডের টাকা আত্মসাতের কথা শুনেছি। মনোয়ার হোসেনের পর সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রদ্যুৎ কুমার ভদ্রকে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন চাপের কারণে তিনিও পদত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান।

জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে এরপর দায়িত্ব দেওয়া হয় তোফায়েল আহমেদ ভূঁইয়াকে। তিনি রিয়াজ উদ্দিনের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। গভর্নিং বডির সভাপতির পদ থেকে রিয়াজ পদত্যাগ করার পর তিনিও ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক নুরুন্নাহারকে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি তিন মাস দায়িত্ব পালন করেন, এরপরে অবসরে চলে যান। সর্বশেষ ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পান জোবেদা বেগম। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তিনিও পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পরও নিজেকে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল বলে দাবি করেন তিনি। জোবেদা বেগম বলেন, জোরপূর্বক একটি কাগজে তারা স্বাক্ষর নিয়েছিল। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে গ্রাফিতি করতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল জোবেদা বেগম অস্বীকৃতি জানান। এরপর শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগের দাবি করেন।

অভিযোগ আছে, ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল জোবেদা বেগম ক্ষমতা ব্যবহার করে কলেজের নিজস্ব ভবনে তার পরিবার নিয়ে বসবাস করার জন্য কলেজের ৬ লাখ টাকা খরচ করে ভবনটি মেরামত করান। কলেজের মাঠ সংস্কার করান আড়াই লাখ টাকা দিয়ে। কলেজ প্রাঙ্গণে গাছ লাগানোর জন্য এক দাতা সদস্য ২০ লাখ টাকা দিলেও সেই টাকার তথ্য নেই।

এদিকে বিয়াজের পদত্যাগের পর ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মমতাজ বেগম প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্ব পান। তিনিও রিয়াজের আমলে হওয়া দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে জোরালো কোনো ভূমিকার রাখেননি বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী শিক্ষক আকলিমা আক্তার বলেন, শিক্ষকদের দাবির মুখে ২০২৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ পদত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মমতাজ বেগম আমাদের প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রিয়াজের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তিনি কোনো জোরাল ভূমিকা রাখেননি। নিয়মবহির্ভূতভাবে রিয়াজ যেসব শিক্ষকের বেতন বাড়িয়েছেন, বিভিন্ন অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছেন, শিক্ষকরা এক বছর ধরে মমতাজ বেগমের কাছে সেগুলো ঠিক করতে বললেও কোনো ফল হয়নি। এ নিয়ে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সর্বশেষ যে প্রিন্সিপাল পদত্যাগ করেছেন, তাকেও আমরা বৈষম্য দূর করতে বলেছিলাম, তিনিও তা করেননি। রিয়াজ উদ্দিন শিক্ষকদের মধ্যে যে বৈষম্য তৈরি করে গেছেন, তা এখনো রয়ে গেছে।

ফেসবুক পোস্টে লাইক দেওয়ায় দুই মাস অব্যাহতি দেওয়া শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক নুসরাত জাহান বলেন, আমি আসলে ফেসবুক সম্পর্কে তেমন কিছু বুঝি না। কিন্তু একটি পোস্টে না বুঝে লাইক দিয়েছি এবং শেয়ার করেছি, তাতে আমাকে দুই মাস সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছিল কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি রিয়াজ।

যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক হাসনা খানম বলেন, এক বছর ধরে কলেজ থেকে শিক্ষকরা বেতন পান না। রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ প্রধান শিক্ষক মরিয়ম বেগমের সঙ্গে মিলে কলেজের ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এখন কলেজের ফান্ড খালি; তাই আমাদের বেতন দিতে পারছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার সরকারি কাজ বাগিয়ে নেন রিয়াজ। এসবের বেশিরভাগ কাজই তিনি বিক্রি করে দেন।

এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৫ শতাংশ কমিশনে বিভিন্ন ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতেন তিনি। এমনকি মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ঘুষ-বাণিজ্যও করেছেন রিয়াজ। এরপর দীপু মনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হলে মতিঝিল এলাকায় মুক্তা পানির ডিলারকে বাতিল করে ডিলারশিপ নেন রিয়াজ। বালুখেকো সেলিমের কাছ থেকে প্রতি মাসে লাখ টাকা চাঁদা নিতেন তিনি।

অনিয়ম আর দুর্নীতি করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হন রিয়াজ। রাজধানীর টিকাটুলী ও ওয়ারি এলাকায় চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। এর মধ্যে দুই স্ত্রীকে দুটি ফ্ল্যাট গিফট করেছেন। রয়েছে দুটি গাড়ি। নারায়ণগঞ্জ ও মোহাম্মদপুরে জমি কিনেছেন। চাঁদপুরে গ্রামের বাড়িতে ১০০ শতাংশ জমি কিনেছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ বলেন, কলেজ থেকে টাকা যদি নিয়ে থাকি, তাহলে তো আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে। ব্যাংক স্টেটমেন্ট তো থাকবে। ব্যাংকে প্রমাণও থাকবে। আর ওখানে তো আমি যাওয়ার পরে ফান্ডে টাকা ছিল না। ব্যাংকে যোগাযোগ করলে সব পাওয়া যাবে।’ বাকি অভিযোগের বিষয়ে তিনি কথা বলেননি।