দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিবিধ খাতের কোম্পানি খান ব্রার্দাসের শেয়ার নিয়ে হরহামেশা কারসাজি চলছে। কারসাজিকারীদের নিরাপদে সটকে পড়তে কোম্পানিটি নামমাত্র ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শেয়ারটির কারসাজির সঙ্গে পুঁজিবাজারে কারসাজির ‘কিং’ খ্যাত কয়েকজন বিনিয়োগকারী জড়িত। তার সঙ্গে কোম্পানির কর্মকর্তারাও জড়িত বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন।

একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে অভিযোগের সুরে বলেন, খান ব্রার্দাসের লভ্যাংশ নিয়ে কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। কোম্পানিটি ১ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়ে শেয়ার কারসাজির বৈধতা দিয়েছেন। সর্বশেষ হিসাববছরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি ১ পয়সা আয় নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠছে। কারণ আগের বছর শেয়ার প্রতি ৬ পয়সা লোকসান হয়েছিল।

এছাড়া বন্ধ ও লোকসানী কোম্পানি হঠাৎ করে কী ভাবে মুনাফা করলেন। এছাড়া ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ কারসাজি চক্র মালিক পক্ষকে নগদ টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে নতুন করে কারসাজির ফাঁদ পতে যাতে চড়া দামে শেয়ারটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে চাপিয়ে তারা নিরাপদে সটকে পড়তে পারে, সেজন্য নামমাত্র লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, কোম্পানিটি যে মুনাফা দেখিয়েছে, তাও সঠিক নয়। কারসাজির জন্য মুনাফা ফুলিয়ে-ফাপিয়ে দেখানো হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার নিয়ে সিরিজ কারসাজি চলছে। একটি চক্র পরিকল্পিত ভাবে শেয়ারটি নিয়ে কারসাজি করছেন। এসব নিয়ন্ত্রক সংস্থা দেখেও না দেখার ভান করছেন। মুলত ২০২২ সালের নভেম্বর মাসেও শেয়ারটির দর ছিল ১৩ টাকা ৮০ পয়সা। মুলত গত দুই বছর ধরে খান ব্রাদার্সের শেয়ারের দাম বাড়ার পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে। যেন রূপকথার ‘আলাদিনের চেরাগ’ কেও হার মানাচ্ছে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের শেয়ার। দুই বছরের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে প্রায় দুই হাজার শতাংশ।

প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের এমন দাম বাড়াকে অস্বাভাবিক বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের আর্থিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। লোকসানের কারণে কোম্পানিটি ২০২৩ সালে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এমন একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রায় দুই হাজার শতাংশ বেড়ে যাওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না।

কোনো বিশেষ চক্র পরিকল্পিতভাবে এই কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। ফলে খান ব্রদার্সের দাম বাড়ার চিত্র দেখলে খুব সহজেই বোঝা যায় কোনো বিশেষ গোষ্ঠী এই দাম বাড়ানোর পেছনে রয়েছে। যে কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত লভ্যাংশ দিতে পারে না, সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০ টাকা থেকে ২১৮ টাকা হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। সবশের্ষ গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ার দর লেনদেন হয়েছে ১৫২ টাকা ৭০ পয়সা।

অভিযোগ রয়েছে, খান বার্দাসের শেয়ার কারসাজির সাথে বিকন গ্রুপের যোগ সূত্রতা রয়েছে। এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন বাজারের কারসাজির চক্রের মুল হোতা আশরাফ, খলিল ও জীবন। মুলত এ সিন্ডিকেট চক্র বিকন গ্রুপের এবাদুল করিমকে বিভিন্ন রকমের ভুল পরামর্শ দিয়ে জেড ক্যাটাগরির শেয়ার কিনে কমিশন বানিজ্যের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ চক্রের হোতা বিকন গ্রুপের খলিল টাকা কামিয়ে এখন বিকল্প উপায় খুঁজছেন। মুলত এরা বিকন গ্রুপের ফান্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন দুর্বল মৌল ভিত্তি শেয়ার নিয়ে হরহামেশা কারসাজির করছেন। এ চক্রটি কারসাজি করে শত শত কোটি টাকা বাজার থেকে লোপাট করছেন।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, খান ব্রদার্সের দাম বাড়ার চিত্র দেখলে খুব সহজেই বোঝা যায় কোনো বিশেষ গোষ্ঠী এই দাম বাড়ানোর পেছনে রয়েছে। এই গোষ্ঠী নিজেরা নিজেরাই লেনদেন করে শেয়ারের দাম বাড়াতে পারে। এ বিষয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকা উচিত। যে কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত লভ্যাংশ দিতে পারে না, সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০ টাকার শেয়ার ১৫২ টাকা হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়।

তথ্য মতে, কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৯ কোটি ৮০ লাখ ৭৯ হাজার ৮৭৭টি। ২০১৪ সালে কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটি ধারাবাহিক লোকসানে ছিল। এর মধ্যে ২০২০ ও ২০২২ সালে ২ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল।
জানা যায়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণ খুঁজতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণ তদন্ত করে আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে তদন্তের দুই মাস পেরিয়ে গেলে আজও অন্ধকারে বিনিয়োগকারীরা। দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণসহ কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল ‘আলাদিনের চেরাগ খান ব্রাদার্স, একটি চক্রের কারসাজির একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ঐ প্রতিবেদনে কোম্পানিটির শেয়ার দাম কীভাবে বেড়েছে সে তথ্য তুলে ধরা হয়। এরপর দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পর এখন কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ওঠা-নামা নিয়ে সম্প্রতি তদন্তের নির্দেশ দিলো বিএসইসি।

বিএসইসির এ সংক্রান্ত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এটা লক্ষ্য করা যায় যে, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ারের দাম এবং লেনদেনের পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ওঠানামা করেছে, যা অস্বাভাবিক এবং সন্দেহজনক বলে মনে করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ডিএসইকে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের লেনদেন সম্পর্কে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হলো। উল্লেখিত কোম্পানির শেয়ারের দাম এবং লেনদেনের পরিমাণ এই ধরনের অস্বাভাবিক গতিবিধির পেছনের কারণ (বাজারের কারসাজি, ইনসাইডার ট্রেডিং এবং অন্যান্য বাজারের অপব্যবহারসহ) চিহ্নিত করার নির্দেশ দেওয়া হলো।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটির কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসা করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ সময় ধরে লোকসান গুনছে। বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময়ও কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি; বরং যেনতেন কোম্পানির শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে সূচক বাড়লেই তাতে সন্তুষ্ট থাকত শিবলী কমিশন।

বন্ধ ও লোকসানি এই কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যেই দীর্ঘদিন ধরেই নানা প্রশ্ন দেখা দিলেও কমিশনের নীরবতা কারসাজিকারকদের উৎসাহিত করে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন কমিশন দায়িত্ব নিলেও কারসাজির মাধ্যমে কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে নতুন কমিশন এ মূল্যবৃদ্ধি কারণ খতিয়ে দেখতে ডিএসইকে নির্দেশ দেয়।