ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ঋণের নামে ৯৮ কোটি টাকা লোপাট
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা খাতের কোম্পানি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ঋণের নামে জালিয়াতি করে প্রায় ৯৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা এর সঙ্গে জড়িত। ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের (এনডিই) নামে ভুয়া বিল ভাউচারে এই অর্থ আত্মসাৎ হয়। অনুসন্ধানে জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জড়িতদের বিরুদ্ধে শিগগির তিনটি মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অর্থ আত্মসাতের এই অভিযোগ অনুসন্ধান করেন দুদক প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক সৈয়দ তাহসিনুল হক (তৎকালীন উপপরিচালক)। তিনি বলেন, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সকে ঋণ প্রদানের নামে জালিয়াতির মাধ্যমে ফারইস্টের ৯৭ কোটি ৮১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে।
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, প্রথম দফায় ১৬টি চেকে ১৩ কোটি ৭১ লাখ ৫১ হাজার টাকা, দ্বিতীয় দফায় ১৭টি চেকে ১৩ কোটি ৯০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা এবং তৃতীয় দফায় ১১১টি চেকে ৭০ কোটি ১৯ লাখ ৭৯ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। ঋণের নামে এই অর্থ ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সকে দিতে ফারইস্টের ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট সাব কমিটি (আইআরডিসি) একাধিক সভা করে। তবে সভার হাজিরা খাতায় কমিটির সদস্যদের সই থাকলেও ঋণ অনুমোদনের রেজুলেশনে নেই।
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স ২০১৭ সালের শুরুর দিকে রাজশাহীতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১৯ তলা ভবন নির্মাণে মোট খরচের ৩০ শতাংশ অগ্রিম দেওয়ার জন্য আবেদন করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানটিকে ১৩ কোটি ৯০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, এ অর্থ ঋণ হিসেবে বিবেচিত হবে। ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের অফিসিয়াল প্যাডে কোম্পানির পরিচালক রেজওয়ান মোস্তাফিজ ফারইস্টের নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদনটি করেন।
২০১৭ সালের ১ মার্চ ফারইস্টের আইআরডিসির ২৭১তম সভায় এ ব্যাপারে আলোচনা হয়। সভায় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামসহ সাব-কমিটির ১৭ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। হাজিরা খাতায় তাদের সই রয়েছে। সভার আলোচ্যসূচির ৩ নম্বরে ছিল ভবন নির্মাণ-সংক্রান্ত ঋণের বিষয়টি। তবে কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী আমীর মোহাম্মদ ইব্রাহীম স্বাক্ষরিত আরেক এজেন্ডায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অনুসন্ধানকালে দুদক ওই সভার রেজুলেশন সংগ্রহ করে। এ রেজুলেশনে কোম্পানির চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট কারও স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি।
রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দুদক বলছে, ফারইস্টের আইআরডিসির ২৭১তম সভায় ন্যাশনাল ডেভেলমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংকে ঋণ হিসেবে ১২ কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, যা সভার রেজুলেশনে উল্লেখ রয়েছে। সভায় এই ঋণ অনুমোদনও হয়। পাশাপাশি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র উপস্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়। সভার হাজিরা খাতায় ফারইস্ট পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম ছাড়াও সই করেন সাব কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আতিয়ার রহমান, আলহাজ মো. হেলাল মিয়া, আয়েশা হোসনে জাহান, নাজনীন হোসাইন, কে এম খালেদ, শেখ মো. হাসান, ডা. মো. মনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক ড. ইফফাত জাহান, রাবেয়া বেগম, মুসলীমা শিরিন, রুবাইয়াত খালেদ, মো. তানভিরুল হক, সাইমন আহমেদ, মো. তাজুল ইসলাম, এ কে এম মনিরুল ইসলাম এবং কোম্পানির সিইও মো. হেমায়েত উল্লাহ।
তবে সভায় ১২ কোটি টাকার অনুমোদন হলেও ১৪ কোটি টাকা অনুমোদনের কথা উল্লেখ করে কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী আমীর মোহাম্মদ ইব্রাহীম সংশ্লিষ্ট সব শাখায় চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন। কোম্পানির জার্নাল ভাউচার অনুযায়ী, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সকে শেষ পর্যন্ত ১৩ কোটি ৯০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত ভাউচারে প্রস্তুতকারী ও নিরীক্ষাকারীর সংক্ষিপ্ত সই থাকলেও অনুমোদনকারী ও প্রদানকারীর সই নেই। ভাউচারে সংক্ষিপ্ত সই প্রদানকারীকে শনাক্ত করা যায়নি। ভাউচারের সঙ্গে কোনো পেমেন্ট নোট বা নিরীক্ষিত কাগজপত্রও পাওয়া যায়নি।
দুদক বলছে, ফারইস্টের সাবেক ডিএমডি ও কোম্পানি সচিব আব্দুল আজিজ এবং কোম্পানির সিইও হেমায়েত উল্লাহর স্বাক্ষরে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ১৭টি চেকে ওই ১৩ কোটি ৯০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দুদক জানায়, পৃথক ঘটনায় আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকসহ দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের তিনটি হিসাব থেকে ১৬টি চেকের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১৩ কোটি ৭১ লাখ ৫১ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কোম্পানির সাবেক ডিএমডি ও কোম্পানি সচিব সৈয়দ আব্দুল আজিজ এবং কোম্পানির সিইও হেমায়েত উল্লাহর স্বাক্ষরে এই অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফারইস্টের সাবেক পরিচালক এম এ খালেক, সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী আমীর মোহাম্মদ ইব্রাহীম, সাবেক এস এ ভিপি অ্যান্ড কোম্পানি সেক্রেটারি সৈয়দ আব্দুল আজিজ, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়েত উল্যাহ ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সকে অগ্রিম প্রদানের নামে ওই অর্থ আত্মসাৎ করেন।
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ফারইস্ট আইআরডিসির ২৬৪তম সভার আলোচ্যসূচিতে ১২ নম্বরে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সকে অগ্রিম হিসেবে আরও অর্থ প্রদানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সভায় প্রতিষ্ঠানটিকে ৭০ কোটি ১৯ লাখ ৭৯ হাজার টাকা প্রদানের অনুমোদন দেওয়া হয়।
তবে সভার রেজুলেশনে কোম্পানির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও কোনো সদস্যের স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। হাজিরা খাতা অনুযায়ী সভায় উপস্থিত ছিলেন কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, পরিচালক এম এ খালেক, রুবাইয়াত খালেদ, তাসলিমা ইসলাম, মো. তানভিরুল হক, কে এম খালেদ, আলহাজ মো. হেলাল মিয়া, আয়েশা হোসনে জাহান, নাজনীন হোসাইন, ডা. মো. মনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক ড. ইফফাত জাহান, মো. মোজাম্মেল হোসেন, রাবেয়া বেগম, মুসলীমা শিরিন, নূর মোহাম্মদ ডিকন এবং কোম্পানির সিইও হেমায়েত উল্লাহ।
দুদক বলছে, সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর কবির, ফারইস্টের সাবেক কোম্পানি সচিব সৈয়দ আব্দুল আজীজ, মো. আব্দুল খালেক (এফসিএ), সাবেক সিইও হেমায়েত উল্লাহর স্বাক্ষরে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ১১১টি চেকে ৭০ কোটি ১৯ লাখ ৭৯ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। দুদক পরিচালক সৈয়দ তাহসিনুল হক জানান, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের আরও বিপুল অর্থ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে।