পুঁজিবাজারে লোটাস কামালের হাজার কোটি টাকার লোপাট, নেপথ্যে সিন্ডিকেট চক্র
আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আবু হেনা মোহাম্মদ (আ হ ম) মুস্তফা কামাল। পরিচিত লোটাস কামাল নামে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট; পাঁচবার এমপি ছিলেন কুমিল্লা ১০ আসনের। সামলেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ক্রিকেট সংগঠক হিসেবেও রয়েছে খ্যাতি। সব পরিচয় ছাপিয়ে লোটাস কামাল একজন বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ। অথচ তাঁর হাতেই দেশের অর্থনীতি বলা চলে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। মুলত পতিত স্বৈরাচার শাসনামলে দেশের পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের অন্যতম হোতা লোটাস কামাল সহ একটি সিন্ডিকেট চক্র।
শেয়ার কারসাজি করে চার সিন্ডিকেট চক্রটি পুরো পুঁজিবাজারকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। নানা অভিযোগ থাকার পরও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কোনো ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি। এতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে এই চক্রটি। পুঁজিবাজারে সর্বনাশের পেছনে রয়েছে লোটাস কামাল সহ আর তিন খলিফার হাত। নিয়মকানুন সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলে তাদের অবাধ লুটপাট।
এদিকে পট পরিবর্তন হবে এমন আভাস পেয়েই নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব খালি করে বিদেশে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল ও তার পরিবার। গত জানুয়ারি থেকে তারা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছেন সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা। অভিযোগ আছে, সাবেক এই মন্ত্রী ব্যাংক, পুঁজিবাজার ও সরকারি প্রকল্প থেকে লুটেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। সাম্রাজ্য গড়েছেন দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে।
তথ্য বলছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০১০ সালের পুঁজিবাজার কারসাজি, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট করেছেন কামাল দম্পতি। মেয়ে নাফিসা কামাল বাবার প্রভাব খাটিয়ে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বিভিন্ন সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকায় কোনো সংস্থাই এসব অনিয়মের বিষয়ে টুঁ শব্দও করতে পারেনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউতে তাদের বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ জমা হয়েছে। একই সঙ্গে তদন্তে বেরিয়ে আসছে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ।
এ সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিঃস¦ হয়েছেন পুঁজিবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারীরা। ফলে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে পথে বসছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনকালে যখনই শেয়ার কারসাজি ও জাল-জালিয়াতির কথা উঠেছে তখনই ঘুরে-ফিরে চার খলিফার নাম চলে এসেছে। তারা বাজার কারসাজিতে সহায়তা করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পদগুলোতে নিজেদের পছন্দের লোক বসিয়েছেন। এ চক্র একসঙ্গে মিলেমিশে পুঁজিবাজার থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা।
মুলত লোটাস কামাল শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। মালয়েশিয়ায় কর্মী রপ্তানি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাতিয়েছেন বিপুল অর্থ। মেগা প্রকল্প দেখলেই ‘মাথা নষ্ট’ হয়ে যেত তাঁর। প্রয়োজন না থাকলেও কুমিল্লায় গ্রামের বাড়ির পাশে তিনি বাগিয়ে নেন ‘শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার’ এবং ‘নলেজ পার্ক’ প্রকল্প। স্বজনের মাধ্যমে এসব প্রকল্পের অর্থ হাতিয়ে লোটাস কামাল তকমা পেয়েছেন ‘লুটপাট বিশেষজ্ঞের’।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা জানান, স্বজনপ্রীতিতে ওস্তাদ লোটাস কামালের কাছে গুরুত্বহীন ছিলেন দলের ত্যাগীরা।
মন্ত্রিত্ব ছিল তাঁর টাকা বানানোর মেশিন। এস আলম গ্রুপের সঙ্গে গভীর সখ্য রেখে নিজের ও স্বজনের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট এবং পাচার করেছেন। সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) কে এম সিংহ রতনকে কামাল ‘ছায়ামন্ত্রী’ বানিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন আর্থিক ও ব্যাংক খাত। পেতেন তদবির, নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি বাণিজ্যের কমিশন। ভাইয়ের মাধ্যমে কবজায় রেখেছেন দলীয় পদ-পদবি।
টেন্ডার, টিআর ও কাবিখা থেকে হাতিয়েছেন অর্থ। মুস্তফা কামালের বাবা বাবরু মিয়া ছিলেন দিনমজুর। এলাকায় লোটাস কামাল পরিচিত ছিলেন আদম ব্যবসায়ী হিসেবে। ১৯৯৪ সালে তৎকালীন কুমিল্লা-৯ আসনের এমপি অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার মারা গেলে ভাগ্য খোলে তাঁর। রাজনীতিতে এসে ১৯৯৬ সালে নৌকার টিকিটে প্রথমবার এমপি হন কামাল।
২০০১ সালে পরাজিত হলেও, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তাঁর দল আওয়ামী লীগের মতোই এমপি হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ২০১৪ সালে পরিকল্পনা এবং ২০১৯ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বিসিবি সভাপতি ও ২০১৪ সালে আইসিসির সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগেই চিকিৎসার অজুহাতে পরিবার নিয়ে দেশ ছাড়েন লোটাস কামাল। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় কামাল নিজের চেয়ে স্ত্রী কাশমেরী কামালের সম্পদ বহু গুণ বেশি দেখিয়েছেন। গত ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায় কামালের অস্থাবর সম্পদ ৪১ কোটি ৯০ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। কিন্তু স্ত্রীর দেখিয়েছেন ৬২ কোটি ২৭ লাখ ১৯ হাজার টাকা।
নিজের স্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য ২ কোটি ৩০ লাখ হলেও, স্ত্রীর রয়েছে ৫ কোটি ৪২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও পাঁচ নাতি-নাতনিকে দান করায় সম্পদ কমেছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা শেয়ারের ২ কোটি ৪ লাখ ৫ হাজার টাকা মেয়ে নাফিসা কামালকে এবং স্ত্রী, মেয়ে ও পাঁচ নাতি-নাতনিকে দিয়েছেন ৩১ কোটি টাকার সম্পত্তি।
সূত্র জানায়, হলফনামায় উল্লেখ করা কামালের সম্পদের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে স্বজনের নামে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন তিনি। ২০০৯-১০ সালে শেয়ার কারসাজির ঘটনায় সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ছিলেন আলোচিত নাম। ২০১০ সালে দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে ভয়াবহতম ধসের পর ২০১১ সালে সরকার প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যাংকার খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি করেছিল। ওই কমিটির প্রতিবেদনে কামালের তৎকালীন মালিকানাধীন সিএসএম কামাল টেক্সটাইল নামক লোকসানি কোম্পানির শেয়ারের দর কীভাবে ১৬ গুণ পর্যন্ত বেড়েছিল, তার বিস্তারিত উঠে এসেছে।
ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, লোকসানি হওয়া সত্ত্বেও কোম্পানিটির শেয়ারদর যখন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছিল, তখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পক্ষ থেকে কোম্পানিটির কাছে রুটিন মাফিক ‘দর বৃদ্ধির কোনো কারণ আছে কিনা’ এমন চিঠি দেওয়া হয়। মুস্তফা কামাল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য এবং অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি থাকায় তাঁর কোম্পানির বিষয়ে কোনো তদন্ত করা হয়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯-১০ সালের যেসব ইস্যু ব্যবহার করে কোম্পানি-সংশ্লিষ্টরা তাদের শেয়ারদর প্রভাবিত করেছিলেন, তার সবটাই ব্যবহার করেছিলেন কামাল। যেমন– ওই দুই বছরে কোনো কোম্পানি স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে যাচ্ছে এমন খবর ছড়ালেই সংশ্লিষ্ট শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল। তৎকালীন সিএমসি কামাল টেক্সটাইল নামক তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির মূল মালিকানা ছিল মুস্তফা কামালের। এভাবে শেয়ারদর বাড়াতে লোকসানি কোম্পানি হওয়া সত্ত্বেও স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছিলেন তিনি। কোম্পানির সম্পদ পুনর্মূল্যায়নের খবরে তখন শেয়ারের দর হু-হু করে বেড়েছিল। এ সুযোগও নেন।
আবার রাইট শেয়ার বিক্রি করে মূলধন বৃদ্ধির খবরেও দর বেড়েছিল। ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারকে ভেঙে ১০ টাকার ১০টি শেয়ারে রূপান্তর করেও দর বাড়াতে সহায়তা করেন। কামাল এসব সুযোগও নিয়েছিলেন। এভাবে তাঁর কোম্পানির শেয়ারদর অভিহিত মূল্যের তুলনায় ১৬ গুণ হয়ে যায়। এক সময় যা অভিহিত মূল্যের তুলনায় অর্ধেকে কেনাবেচা হয়েছিল। এমন দর বৃদ্ধির পর কামাল এবং তাঁর পরিচালক সদস্যরা স্টক ডিভিডেন্ড হিসেবে পাওয়া শেয়ারগুলো প্রায় ২১ কোটি টাকা মূল্যে বিক্রি করেছিলেন। ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত দলে এমন অভিযোগ আনা হলেও ঢাকা রিপোর্টার্স ফোরামের অডিটরিয়ামে এক সংবাদ সম্মেলনে মুস্তফা কামাল সিএমসি কামাল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছিলেন।
তিনি দাবি করেন, কোম্পানিতে তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় থাকা মূল শেয়ারের একটিও বিক্রি করেননি। শুধু স্টক ডিভিডেন্ড হিসেবে পাওয়া শেয়ার বিক্রি করেছিলেন। তবে সমকালের প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে কামাল স্বীকার করেন, শুধু বোনাস শেয়ার বিক্রি করে ২১ কোটি টাকা পেয়েছেন, যেখানে কোম্পানিতে তাদের মোট বিনিয়োগ ছিল ৭ কোটি টাকা। এমন বিপুল অঙ্কের মুনাফা পেতে শেয়ারদর বাড়ানোর সব আয়োজন করেছিলেন কিনা এমন প্রশ্ন তোলার পর তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন তিনি।
অভিযোগ আছে, শেয়ার কেনাবেচা করে বিপুল অঙ্কের মুনাফা করেছিলেন কামাল। ওই ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে সমালোচনা এড়াতে কোম্পানিটি আলিফ গ্রুপ নামক একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের কাছে বিক্রি করেন তিনি। এর পর সাবেক অর্থমন্ত্রী নিজ নামে শেয়ার ব্যবসা না করলেও মেয়ে নাফিসা কামাল নানা কারসাজি গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে শত শত কোটি টাকা মুনাফা করেছেন, যার বড় অংশ দুবাইতে পাচার করে সেখানকার রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় খাটিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।