গাজীপুর, দেশ প্রতিক্ষণ: শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুর এখন যেন ধোঁয়া আর ধুলার নগরী। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও শিল্পায়নের কারণে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। অনিয়ন্ত্রিত শিল্পকারখানা আর বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে গত কয়েক বছরে বায়ুদূষণ বেড়েছে কয়েকগুণ। দূষণের শিকার হয়ে নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন নগরবাসী। কিন্তু দূষণরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। নামমাত্র পানি ছিটিয়ে রাস্তার ধুলা দূর করার চেষ্টা করা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।

গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী তুরাগ সেতু থেকে শুরু করে চেরাগআলী পর্যন্ত ধুলাবালি আর ময়লা আবর্জনায় সয়লাব। একই অবস্থা ভোগড়া বাইপাস থেকে কালীগঞ্জ উপজেলার উলুখোলা পর্যন্ত। গাজীপুর শহর ও আশপাশের কোথাও ধুলাবালির হাত থেকে রেহাই মেলে না। দূষিত বাতাসের কারণে এখন প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গাজীপুরের বাসিন্দাদের।

ফলে বিভিন্ন অবকাঠামোগত নির্মাণকাজের ধুলোবালি আর কলকারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় এখানকার দূষণ বাড়ছেই। দিন যত যাচ্ছে, গাজীপুরের বায়ুর মানের অবনতি ততই বেড়ে চলেছে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে দূষণের শীর্ষ তালিকায় উঠে এসেছে গাজীপুর জেলা। আর জেলার সবচেয়ে দূষিত এলাকা টঙ্গী। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় এস এস স্টিল মিলস নামে একটি রড তৈরির কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা আছেন সবচেয়ে ঝুঁকিতে।

স্থানীয়রা জানান, এস এস স্টিল মিলসের ভয়াবহ দূষণের শিকার এই টঙ্গী শিল্পাঞ্চলের মানুষ। বিষাক্ত ধোঁয়া আর শব্দ নিয়ন্ত্রণে নেই ন্যূনতম পদক্ষেপ। ফলে মাশুল গুনতে হচ্ছে আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের। অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মিলছে না। পরিবেশ অধিদপ্তর দায়সারা কাজ করছে। ঘন কালো ধোঁয়ার কারণে দিনের বেলায়ও রাতের মতো অন্ধকার থাকে। বিশেষ করে সকালবেলা তো কিছুই দেখা যায় না। মনে হয়, এখনো ভোরের আলো ফোটেনি। অথচ হাতঘড়িতে সকাল ১০টা পেরিয়ে গেছে।

এলাকাবাসী ও এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, কারখানাটির ধোঁয়া শোধনের কোনো উদ্যোগই নেই। চুল্লিতে জ্বলে পুরোনো লোহার টুকরো। নির্গমন চিমনির উচ্চতা এখানে কম। তাই ধোঁয়া ছাদ ও দেয়ালের টিনের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সহজেই। সেই ধোঁয়ায় কালোর আস্তরণ আশপাশের দেয়ালে দেয়ালে। বাতাসে উড়ে ছাই এসে পড়ছে গাছপালা আর আশপাশের বিভিন্ন স্থাপনায়। এই ধোঁয়ার কারণে ঝুঁকিতে আছে অন্য শিল্পকারখানাও। এমন ভয়াবহ দূষণের কারণে অনেক বিদেশি পোশাক ক্রেতা এ এলাকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, এসএস স্টিল মিলসের যন্ত্রাংশ মরিচা ধরা। ঝুলে থাকা টিন দিয়ে ঘেরা কারখানাটি। ভেতরে বিকট শব্দ। ধোঁয়া নির্গমনের চিমনি থাকলেও চারপাশ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়ছে আকাশে। এসএস স্টিল মিলস থেকে নির্গত ধোঁয়ার কারণে পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে আছে।
কারখানার বাঁ পাশে বস্তির প্রবেশমুখে একটি কাঁচাবাজার। সেখানকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মিলের চুল্লিতে লোহার টুকরো গলার কারণে সবসময় ধোঁয়া ওড়ে। দিনের যে কোনো সময় পুরোনো লোহা পোড়ানোর ফলে আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হয়, যা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়।

দূষণের শিকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কালো ধোঁয়ার কারণে শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে পড়েছে। অনেকেই আক্রান্ত শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগবালাইয়ে। এস এস স্টিল মিলে কাজ করছেন শতাধিক শ্রমিক। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কারখানার শব্দদূষণের শিকার তারাও। শুধু ধোঁয়া কিংবা শব্দ নয়, এসএস স্টিল মিলের ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামোয় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এ নিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, অভিযোগ দেওয়ার ১০ মাস পর পরিবেশ অধিদপ্তর এসএস স্টিল মিলের লাইসেন্স নবায়ন বাতিল করে। এর পরও কারখানাটি চলছে এবং প্রতিনিয়ত দূষণ চালিয়ে যাচ্ছে।

আবদুল মতিন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ধোঁয়ায় আকাশ দেখা যায় না। ১০ হাত দূরেও কিছু দেখা যায় না। অনেক কষ্টে আছি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।’ হামিম গ্রুপের এক গার্মেন্টস কর্মী শেফালী আক্তার বলেন, এই ধোঁয়ার কারণে আমরা ঠিকমতো কাপড় শুকাতে পারি না। কাপড় রোদে দেওয়া যায় না। ধোঁয়ার কারণে সব কালো হয়ে যায়। ঘরের মধ্যে কাপড় শুকাতে দিলেও কাপড়ে কালো আস্তর পড়ে থাকে। আমরা খুব বিপদে আছি। এখানে ঘরে ঘরে সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট লেগেই আছে।

জানা গেছে, এই স্টিল মিলের বিষাক্ত ধোঁয়ায় কারণে আশপাশের রপ্তানিমুখী পোশাক ও অন্য কারখানাগুলোর কয়েক হাজার শ্রমিকের কাজের বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। হামিম গ্রুপের এক কর্মী লেয়াকত শিকদার বলেন, ধোঁয়ায় শুধু কর্মীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন তা-ই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারখানার অবকাঠামো ও রপ্তানি পণ্যও। টঙ্গী পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, এসএস স্টিল যে বায়ুদূষণ করছে, তা নয়, পানিও দূষণ করে। এখানকার উত্তপ্ত পানি বিভিন্ন নালা দিয়ে ছেড়ে দেয়। এতে আশপাশের নালার মাছ ও কৃষিজমি নষ্ট হয়ে যায়।

অভিযোগের বিষয়ে এসএস স্টিল মিলসের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মো. রাসেল বলেন, পরিবেশ আইন মেনেই তাদের কারখানা চালানো হচ্ছে। কোম্পানিরটির নবায়ন বাতিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি সঠিক। নতুন করে নবায়ন করা হয়েছে। এ সময় এই প্রতিবেদক নবায়নের কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে পারেননি।

এ বিষয়ে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আরেফিন বাদল বলেন, এসএস স্টিল মিলস হাইকোর্টে একটি রিট করেছে। ওই রিটের বিপরীতে পরিবেশের আইনজীবী কাজ করছেন।