শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: তারল্য সংকটে গ্রাহকরা যে কেবল নগদ উত্তোলনের ক্ষেত্রেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছে; তা নয়। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ার কিনেছেন যারা, অনেক দিন ধরেই লোকসানি হিসেবের চাপে ভালো নেই তারাও। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদন বলছে, দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬টি ব্যাংকের মধ্যে লোকসানে পড়েছে ৯টি ব্যাংক।

মুলত কয়েক বছর ধরেই মুনাফার ধারায় চলছে দেশের প্রায় সব ব্যাংক। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশেষ করে জুলাই জুড়ে টানা আন্দোলন ও আগস্টে সরকার পতনের প্রভাব পড়েছে দেশের সব খাতে। এর বাইরে থাকেনি ব্যাংক খাতও। এতে দেশের অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মুনাফায়। এর মধ্যে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে নয়টি ব্যাংক লোকসান করেছে। আর মুনাফা কমেছে আরও ১০টি ব্যাংকের। যদিও গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে মাত্র দুটি ব্যাংক লোকসানে ছিল।

ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়পর্বে সর্বোচ্চ লোকসান করেছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটি তিন মাসে কর-পরবর্তী লোকসান করেছে ৬৯৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আর এক্সিম ব্যাংক কর-পরবর্তী লোকসান করেছে ৫৬৬ কোটি ৩ লাখ টাকা, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

কর-পরবর্তী লোকসান করা অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্যাংক এশিয়া ১০৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা, ইসলামী ব্যাংক ৮৯ কোটি ২০ লাখ ও ইউনিয়ন ব্যাংক ৮০ কোটি ১৮ লাখ টাকা উল্লেখযোগ্য। এ সময়ে আগের বছরে একই সময়ের তুলানায় মুনাফা কমেছে আরও দশ ব্যাংকের। এর মধ্যে রয়েছে: এবি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংক।

ব্যাংকগুলোর অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ন্যাশনাল ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কর-পরবর্তীতে ব্যাংকটির লোকসান হয়েছে ৬৯৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে লোকসান ছিল ৪৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ লোকসানের ব্যবাধান বেড়েছে ২০১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বা ৪০ শতাংশ।

এক্সিম ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তীতে ব্যাংকটির লোকসান হয়েছে ৫৬৬ কোটি ৩ লাখ টাকা, যা ২০২৩ সালের একই সময়ে মুনাফা ছিল ৫৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে ৬১৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা অর্থাৎ ব্যাংকটি মুনাফা থেকে বড় অঙ্কের লোকসান চলে গেছে।

ব্যাংক এশিয়া ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তীতে ব্যাংকটির লোকসান হয়েছে ১০৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা মুনাফা। এ হিসাবে ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে ১৩০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটি মুনাফা থেকে লোকসানে গেছে। ইসলামী ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তীতে লোকসান করেছে ৮৯ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। অর্থাৎ ব্যাংকটি মুনাফা কমেছে ১৮৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বা ১৯৪ শতাংশ।

ইউনিয়ন ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তীতে লোকসান করেছে ৮০ কোটি ১৮ লাখ টাকা, যা ২০২৩ সালের একই সময়ে মুনাফা ছিল ৫২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে ১৩২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বা ২৫২ শতাংশ। আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী লোকসান করেছে ৪৬ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা ২০২৩ সালের একই সময়ে মুনাফা ছিল ৪৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে ৯০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বা ২০৩ শতাংশ।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক লিমিটেড ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী লোকসান করেছে ৩১ কোটি ৩১ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা। অর্থাৎ ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে ৬৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা বা ১৮২ শতাংশ। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তীতে লোকসান করেছে ২৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা মুনাফা। অর্থাৎ ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ৮৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা বা ১৫১ শতাংশ।

আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী লোকসান করেছে ১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে লোকসান ছিল ১১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির লোকসান বেড়েছে ৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

এছাড়া মুনাফা কমে যাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে ২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে ৮ কোটি ৩২ লাখ বা ৭৪ শতাংশ। মিডল্যান্ড ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে ৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা মুনাফা।

অর্থাৎ ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ৮ কোটি ৪ লাখ টাকা বা ৫৮ শতাংশ। রূপালী ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে ৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ৫ লাখ টাকা বা দশমিক ৯৬ শতাংশ।

আইএফআইসি ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তীতে মুনাফা করেছে ৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ১৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বা ৬৮ শতাংশ। এনআরবি ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তীতে মুনাফা করেছে ৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা মুনাফা। অর্থাৎ ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ৫০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বা ৮৫ শতাংশ।

ঢাকা ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে ২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা মুনাফা। অর্থাৎ ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ৩২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বা ৫৬ শতাংশ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে ৩৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৭৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা মুনাফা। অর্থাৎ ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ১৩৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা বা ৮০ শতাংশ।

সাউথইস্ট ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে ৩৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ৮০ কোটি ১৬ লাখ টাকা বা ৭০ শতাংশ। প্রিমিয়ার ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে ৫৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১২৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা।

অর্থাৎ ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ৬৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বা ৫৬ শতাংশ। ইস্টার্ন ব্যাংক ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে ১৪০ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৮৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ৪২ কোটি ৬০ লাখ টাকা বা ২৩ শতাংশ।

এদিকে বিশ্বজুড়ে ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি আগ্রহ থাকলেও আমাদের পুঁজিবাজারে অনেক ব্যাংকেরই শেয়ার দর ফেসভ্যালুর নিচে। যেমন খেলাপি ঋণে জর্জরিত ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসি। ব্যাংকটির প্রতিটি শেয়ারের দাম জানুয়ারি মাসে ৮ টাকার বেশি থাকলেও অক্টোবরে নেমেছে সাড়ে ৫ টাকায়। এদিকে লাভে থাকা শরীয়াভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকও গত প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি লোকসান দিয়েছে ৩ টাকা ৯১ পয়সা। আর এস আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ইসলামি, ইউনিয়ন, সোশ্যাল ইসলামি ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকেরও লোকসানের ধারা অব্যাহত আছে। লোকসানির তালিকায় নতুন করে যোগ হয়েছে ব্যাংক এশিয়া এবং আল আরাফাহ ইসলামি ব্যাংক।

আইসিবি চেয়ারম্যান আবু আহমেদ বলেন, আগে কিন্তু খারাপ ব্যাংক বা ভালো ব্যাংক নিয়ে কোনো কথা ছিল না। গত দেড় দশকে সীমাহীন দুর্নীতিই ব্যাংকখাতের এই অবস্থার প্রধান কারণ। খোদ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিই বলছে, ঋণখেলাপি ও কারসাজিকারীরা যতোদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে ততোদিন অন্য কোনো উদ্যোগই স্বস্তি দিতে পারবে না বিনিয়োগকারীদের।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, আইনের শাসন যত বেশি পরিপালিত হবে তত বেশি আস্থা বাড়বে বিনিয়োগকারীদের। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে স্বচ্ছ ও সমৃদ্ধ পুঁজিবাজার গড়ে তোলা সম্ভব।