শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের সম্ভাবনাময় পুঁজিবাজার আজ রূপকথার গল্পের মতো, নানা সংকটে বিধ্বস্ত। পতনের তাণ্ডব চলছে দীর্ঘদিন। পুরো বাজার কাঠামোই দুর্বল অস্তিত্বে টিকে আছে। মূল্যস্তর তলানিতে। যেখানে একটা সিগারেটের দামে মিলছে ৬ থেকে ৭টি শেয়ার। ক্রমেই রক্তাক্ত হচ্ছে পুঁজিবাজার। দেখার যেন কেউ নেই। তাছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আস্থা সংকটে ভুগছে বিনিয়োগকারীরা। বিশেষ করে বিএসইসির চেয়ারম্যানের একেক সময় একেক হুটহাট সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে দীর্ঘ দরপতনে দেশের পুঁজিবাজারে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা এতোটাই ভারি হয়েছে যে, তারা বাজারে আসাই বন্ধ করে দিচ্ছেন। এমনকি অনেক বিনিয়োগকারী বড় লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

এমন অবস্থায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক শিবলী কমিশনের সময়কালে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসা কারসাজিকারক আবুল খায়ের হিরু, তাঁর পরিবারের সদস্য ও সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানকে শেয়ার কারসাজির দায়ে ১৩৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ফলে এত বড় জরিমানা কারনে ফের আতঙ্কে ভুগছে বিনিয়োগকারীরা। যার প্রভাব গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের বড় দরপতন হয়েছে।

ফলে পতন থামাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ কোনো পর্যায় থেকে কোনো উদ্যোগ না থাকায় এই হতাশা বিনিয়োগকারীদের বাজারবিমুখ করতে শুরু করেছে। এ কারণে প্রতিদিনই বাজার ছেড়ে যাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। তাতে বাজারে ক্রেতার সংকট দেখা দিয়েছে। তার বিপরীতে বিক্রেতা বেশি। তবে চলমান এ দরপতনে চরমভাবে আস্থা ও তারল্য সংকটে পড়েছে পুঁজিবাজার।

তাছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আস্থা সংকট থাকায় নতুন বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হচ্ছেন না। এছাড়া ‘এখনও বিনিয়োগ করলে লোকসান হবে’ এমন ভয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা হাতগুটিয়ে বসে আছেন। ফলে বাজারে নতুন করে তারল্য সংকট প্রবল আকারে দেখা দিয়েছে। সংকট আরও দিন দিন ঘনীভূত হওয়ার শঙ্কা বিনিয়োগকারীসহ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া নতুনদের আকৃষ্ট করতে না পারা এবং বাজারে সক্রিয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার অভাবে সংকট আরও গভীর হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে অংশীজনের অংশগ্রহণ কমছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাজারে সুফলভোগীরাও নতুন বিনিয়োগ থেকে সরে এসেছেন। এছাড়া প্রতিনিয়ত ফোর্সসেলে বাজার দরপতনকে আরো উস্কে দিয়েছে। শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজগুলো থেকে প্রতিনিয়ত ফোর্সসেল হচ্ছে। ফোর্সসেল বন্ধে কোন কার্যকরী উদ্যোগ নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অপরিপক্ব সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। যদিও পুঁজিবাজার সংস্কারের অংশ হিসেবে বিএসইসির নীতিনির্ধারণীর দায়িত্ব নিয়েছে নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনার। এরই মধ্যে দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় চার মাস পেরিয়ে গেলেও আস্থার উন্নয়ন তো দূরের কথা, উল্টো আস্থা আরও তলানিতে নেমেছে।

একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে বলেন, বিএসইসি চেয়ারম্যান কী পুঁজিবাজার ভাল চায় এনিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি পুঁজিবাজার সংস্কারের নামে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছেন। এছাড়া তিনি বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা না ফিরিয়ে একেক পর এক জরিমানা করে বাজারকে অস্থিতিশীল করছেন।
বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, দীর্ঘ দরপতনে আমাদের পুঁজি শেষের পথে।

বাজারে বিনিয়োগকারী নেই বললেই চলে। এমন সময় বিএসইসি চেয়ারম্যান দায়িত্ব নিয়ে বাজারের মার্কেট মেইকারদের সাথে না পথে একেক পর এক জরিমানা করছেন। এ ভাবে বাজার স্থিতিশীল হবে না। বরং দিনের পর দিন বিনিয়োগকারীদের লোকসান বাড়ছে। হাউজগুলোর মালিকরা ট্রেডারদের বেতন দিতে পারছে না। মনে হচ্ছে সংস্কারের নামে পুঁজিবাজারে জরিমানা হিড়িক চলছে বলে তারা মনে করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক এক শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, পুঁজিবাজারে ডাক ঢোল পিটিয়ে বাজারের বড় মেইকারদের জরিমানা করলে বাজার স্বাভাবিক হবে কী ভাবে। এতে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বিএসইসি চেয়ারম্যান এখন ডপর্যন্ত যতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবগুলো বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি গত তিন মাসের অধিক সময়ে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফেরাতে পারেনি। বরং পুঁজিবাজারে সংস্কারের নামে জরিমানা হিড়িক চলছে। এ ভাবে চলতে থাকলে বাজারে কখনোই আস্থা ফিরবে না। বরং এখন পর্যন্ত যারা বিনিয়োগকারী আছে তারাও মুখ ফিরিয়ে নিবেন বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে সপ্তাহজুড়ে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের মিশ্রাবস্থায় লেনদেন হয়েছে। তেমনি সপ্তাহ জুড়ে কমেছে বাজার মূলধন। তবে টাকার পরিমাণে লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। সপ্তাহটিতে ৬৫১ কোটি ৪২ লাখ টাকা বাজার মূলধন কমেছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৬ লাখ ৬৪ হাজার ৩৫৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর বিদায়ী সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৭০৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকায়। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইতে বাজার মূলধন কমেছে ৬৫১ কোটি ৪২ লাখ টাকা বা .১০ শতাংশ।

সপ্তাহটিতে টাকার পরিমাণে লেনদেন ৩১৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯০৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকায়। আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ২২১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। সপ্তাহটিতে ডিএসইর প্রধান সূচক ৪ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৯৬ পয়েন্টে। অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ২ পয়েন্ট এবং ডিএসই-৩০ সূচক ৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ১৬৩ পয়েন্টে এবং ১ হাজার ৯১১ পয়েন্টে।
সপ্তাহটিতে ডিএসইতে ৩৮৪ টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১৬৬ টির, দর কমেছে ১৭৮ টির এবং ৪০টির শেয়ার দর অপরিবর্তিত রয়েছে।

অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) বিদায়ী সপ্তাহে সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৪৮.৭৯ পয়েন্ট বা ০.৩৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৫৮১.১০ পয়েন্টে। সিএসইর অপর সূচক সিএসসিএক্স ২০.৪৪ পয়েন্ট বা ০.২৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৭১.২৯ পয়েন্টে।
অপর ২টি সূচকের মধ্যে সিএসই-৫০ সূচক ০.৯৩ পয়েন্ট বা ০.০৮ শতাংশ কমে এবং সিএসআই সূচক ৭.০৮ পয়েন্ট বা ০.৭৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে- এক হাজার ১০৮.৯৩ পয়েন্টে এবং ৯৪১.৪১ পয়েন্টে। এছাড়া, সিএসই-৩০ সূচক ২৩.৩৪ পয়েন্ট বা ০.১৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৮৯৯.৭০ পয়েন্টে।

সপ্তাহজুড়ে সিএসইতে ৩১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১৭৪টি, কমেছে ১১২টি এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৩টির। সপ্তাহটিতে টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ২৭ কোটি ৫২ লাখ ৪০ হাজার ৯৮৯ টাকার। আর আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ৩০ কোটি ৪২ লাখ ১৮ হাজার ৬৩১ টাকার। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে সিএসইতে লেনদেন কমেছে ২ কোটি ৮৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬৪২ টাকা বা ১০.৫২ শতাংশ।