শীতকালে কুয়াশার কারণে নৌপথে ডাকাতদের দৌরাত্ম্য
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি, দেশ প্রতিক্ষণ: দেশের নৌপথকে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ মনে করছেন জাহাজ মালিক ও শ্রমিকরা। প্রতিনিয়ত ঘটছে চুরি-ডাকাতি। সর্বশেষ চাঁদপুরে ঘটেছে সাত খুনের ঘটনা। তাদের ভাষ্য, নৌপথ নিরাপদ রাখতে না পারলে জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনে সংকট দেখা দেবে। তবে নৌপুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ান বলেছেন, শীতকালে কুয়াশার কারণে নৌপথে চোর-ডাকাতদের দৌরাত্ম্য কিছুটা বাড়ে।
এ জন্য নৌপুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। জাহাজ মালিক ও শ্রমিকদের অভিযোগ, নৌপথে যেসব চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে তার ছিটেফোঁটাও প্রকাশ হয় না। নৌপথ নিরাপদ করতে না পারলে সড়কপথে পণ্য পরিবহন ভাড়া বেড়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে।
ইউনাইটেড শিপিং চট্টগ্রামের অপারেশনাল ইনচার্জ ওমর কাইয়ুম পারভেজ জানান, গত ৮ অক্টোবর এমটি ইউশিল অয়েল ট্যাংকার চট্টগ্রাম পদ্মা অয়েল থেকে ১৮ লাখ ১৬ হাজার লিটার জেট ফুয়েল নিয়ে রওনা হয়। পথে রাত সাড়ে ১০টার দিকে দৌলতখান থানার চৌকিঘাটের আনুমানিক ৫ কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মধ্যে শ্যাওলা চর এলাকায় অন্তত ২৫ জনের ডাকাত দল আক্রমণ করে। তাদের হাতে দেশীয় ধারালো অস্ত্র ছিল।
পাশ দিয়ে যাওয়া অপর দুটি জাহাজ তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলে ডাকাতরা মোবাইল ফোনসহ আড়াই লক্ষাধিক টাকার মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় জাহাজের মাস্টারসহ কয়েকজন আহত হন। পরে দৌলতখান থানায় মামলা হলে পুলিশ বেশ কয়েকজন ডাকাতকে গ্রেপ্তারও করে।
তিনি জানান, জাহাজে ডাকাত এবং চোরের হানা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। একইভাবে সম্প্রতি চট্টগ্রামের পতেঙ্গাসংলগ্ন একটি ঘাটে টিকে গ্রুপের সয়াবিন তেলবাহী একটি জাহাজে আক্রমণ হয়। এ সময় জাহাজটির মাস্টারের হাত কেটে যায়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় জাহাজটি। টিকে গ্রুপের কর্মকর্তা তৌহিদ জানান, এ ধরনের ছোট-খাটো ঘটনা সব সময় ঘটছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম থেকে ঝালকাঠি, বরিশাল, গোদনাইল, চাঁদপুর, বাঘাবাড়ী, ভৈরব, দৌলতপুর, খুলনা, আশুগঞ্জ, নগরবাড়ী, ফতুল্লায় প্রতিদিন তেলবাহী ট্যাংকার আসা-যাওয়া করে। একইভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন পণ্যবাহী লাইটারেজ জাহাজ যায়। একেকটি লাইটারেজ জাহাজে তিন হাজার থেকে চার হাজার টন পণ্য পরিবহন করা হয়। একটি লাইটারেজ জাহাজ যে পণ্য পরিবহন করে তা ট্রাকে করে নিতে গেলে ২০০ থেকে ২৫০টি ট্রাক লাগবে।
চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পর জাহাজগুলো চাঁদপুরে গিয়ে নোঙর করে। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর জোয়ার অথবা ভাটার স্রোত অনুকূলে পেলে জাহাজগুলো সেখান থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। নোঙর করা জাহাজে ডাকাতরা সহজে আক্রমণ করতে পারে।
বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়ন সিনিয়র সহ-সভাপতি নবী আলম বলেন, সারা বছরই নৌপরিবহনে নিয়োজিত জাহাজগুলোতে কোথাও না কোথাও ডাকাতের আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। গত ৫ আগস্টের পর ডাকাতি বেড়েছে। মাস তিনেক আগে এক রাতে ৯টি জাহাজে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ রুটে সবচেয়ে দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর না হলে নৌরুটে ডাকাতি ও খুনের ঘটনা আরও বাড়বে। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগংয়ের সভাপতি হাজি শফি জানান, দীর্ঘ চার দশক ধরে তিনি এই ব্যবসায় আছেন। চাঁদপুরে যে ঘটনা ঘটেছে সে ধরনের ঘটনা কখনো দেখেননি। কেবিনে গিয়ে জবাই করার ঘটনা এটাই প্রথম। নৌপুলিশ এবং কোস্টগার্ডের টহল বাড়াতে হবে। পুরো নৌপথ যেহেতু তাদের আওতায় পড়ে, তাদেরই এই পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫০ জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায় জানিয়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, নৌপথে যে ডাকাতি, হামলা, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে তার ছিটেফোঁটাও প্রকাশ পায় না। সড়কপথে সাংবাদিকদের যে উপস্থিতি থাকে নৌপথে তা নেই বললেই চলে।
এ বিষয় জানতে চাইলে নৌপুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ান বলেন, সাত খুনের ঘটনার পর নৌপুলিশ টহল বাড়িয়ে দিয়েছে। জাহাজ মালিক-শ্রমিকরা নিরাপত্তার অভাবের যে অভিযোগ করেছেন সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ শুধু নৌপুলিশের পক্ষে শতভাগ নিরাপদ রাখা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। নৌপুলিশের জনবল ও নৌযানের সংকট রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও নৌপুলিশ চেষ্টা করছে নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।