দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য এক দুঃসহ বছর ২০২৪ সাল। দুর্নীতি ও অনিয়মের পাশাপাশি সূচক, শেয়ারের দাম ও বাজার মূলধনের অব্যাহত পতন দেখেছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজারের প্রতি তাঁদের আস্থা প্রায় তলানিতে নেমেছে। ‘লংমার্চ’ কর্মসূচি এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করেছেন বিনিয়োগকারীরা। সংস্থাটির প্রধান ফটকে তালাও ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন বিক্ষুব্ধ কিছু বিনিয়োগকারী।

২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ২৩৩ পয়েন্ট। বছরের শেষ দিকে ২৬ ডিসেম্বর তা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৮৪ পয়েন্টে। ১ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮০ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে ডিএসই বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকা।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএসইসির শীর্ষ পদে বদল আনা হয়েছে। বিদায় নিয়েছে শিবলী রুবাইয়াত-উল–ইসলাম কমিশন। সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে নতুন কমিশন। ডিএসই ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) পর্ষদও বদলানো হয়েছে; কিন্তু বাজারের প্রতি আস্থা এখনো ফেরেনি।

বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারের স্বার্থে সাড়ে চার মাসে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে নতুন কমিশন। কারসাজির অভিযোগে কারও কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিয়েছে। পাশাপাশি টাস্কফোর্সের কাজ চলমান। এখন বিনিয়োগকারীরা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন ২০২৫ সালের দিকে। আগামী বছরে ভালো কিছু দেখার প্রত্যাশা তাঁদের।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিনিয়োগকারীরা কিছুটা আশার আলো দেখেছিলেন। বাজারে চাঙা ভাব ছিল কিছুদিন। কিন্তু একটু ঝলক দেখিয়ে নিভতে থাকে বাতি। গত ২৮ অক্টোবর ডিএসইএক্স সূচক কমে ৪ হাজার ৮৯৮ পয়েন্টে নেমে আসে, যা ছিল চার বছরের মধ্যে নিম্নতম। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পর্যায়ে চলে আসেন বিনিয়োগকারীরা, যা নতুন কমিশনও ঠেকাতে পারেনি।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলেন, ২০২৪ একটি ঘটনাবহুল বছর। বাজারের স্বার্থে নতুন কমিশন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, আশা করা যাচ্ছে ২০২৫ সালে তার ইতিবাচক ফল দেখা যাবে।

যত মূলধন সংগ্রহ: প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ২০২৪ সালে ছয়টি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছে। আর বন্ড ছেড়ে মূলধন সংগ্রহ করেছে দুটি ব্যাংক। মোট তোলা হয়েছে ১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে সংগ্রহ করা হয়েছিল ১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা।

বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আইপিওর মাধ্যমে বোরাক রিয়েল এস্টেটের ৪০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করার আবেদন বাতিল করেছে নতুন কমিশন। বি ব্রাদার্স গার্মেন্টস নামের একটি কোম্পানির ৫০ কোটি টাকা এবং জেনিথ ইসলামি লাইফের ১৫ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহের আবেদনও বাতিল হয়েছে।

৫ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন: পুঁজিবাজার উন্নয়নে পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করেছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। ব্যাংকঋণের বদলে পুঁজিবাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে সরকারের নীতি প্রণয়ন এবং এ-সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিএসইসির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের সুপারিশ করাসহ টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭টি। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে টাস্কফোর্স তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন কমিশনে হস্তান্তর করবে।

নতুন আলোচিত চরিত্র ও জরিমানা: যুগের পর যুগ ধরে পুঁজিবাজারের আলোচিত চরিত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। সুকুক বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা তোলার কারণে ২০২৪ সালেও তিনি আলোচনায় ছিলেন। নতুন করে আলোচনায় আসে ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান এবং সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরু। ১২টি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির কারণে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৭২২ কোটি টাকার জরিমানা করা হয়েছে ২০২৪ সালে।

এ ছাড়া লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেইস ম্যানেজমেন্টের অংশীদার চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, আরেক অংশীদার হাসান তাহের ইমাম, এলআর গ্লোবালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বরখাস্ত সদস্য মতিউর রহমানের।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৪ তো ভালো গেল না। ২০২৫ নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণীও করা যাবে না। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গতি খুবই ধীর। তিনি আরও বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা আগামী বছর শেয়ারবাজারের তুলনায় যদি ট্রেজারি বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করেন, তাহলে বাজারের জন্য তা ভালো খবর হবে না। আমি মনে করি না যে বড় ধরনের কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আবার হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। ভালো কোম্পানিগুলো তো ভালোই লভ্যাংশ দিচ্ছে।’