নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফেরানো বড় চ্যালেঞ্জ
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ২০২৪ সাল মোটেও ভালো যায়নি পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য। বছরজুড়েই পতনের মধ্যে ছিল শেয়ারবাজার। ফলে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ পরিস্থিতিতে আশা-নিরাশার দোলাচলে থেকেই শুরু হচ্ছে ২০২৫ সাল। নতুন বছরে সার্বিকভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে পুঁজিবাজারের জন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, সরকার পতনের পর শেয়ারবাজার উন্নয়নে নানামুখী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব সংস্কার যথাযথভাবে সম্পন্ন করা গেলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে শেয়ারবাজার ভালো করতে হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আস্থার সংকটের কারণে ২০২৪ সালজুড়ে শেয়ারবাজার পতনের মধ্যে ছিল। এখন বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে বিনিয়োগের সুরক্ষা দিতে হবে। একই সঙ্গে বজায় থাকতে হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৪ সালের বেশিরভাগ সময়জুড়েই শেয়ারবাজার পতনের মধ্যে ছিল। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চার কার্যদিবস শেয়ারবাজারে বড় ধরনের উত্থান দেখা যায়। তবে অন্তর্র্বতী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর আবার পতনের ধারায় ফেরে শেয়ারবাজার। একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা।
প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন তিনশ কোটি টাকার নিচে নেমে গেছে। ২০২৪ সালের প্রথমদিন ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ২৪২ পয়েন্টে। বছরব্যাপী দরপতনের ধারা অব্যাহত থাকায় ২৪ ডিসেম্বর লেনদেন শেষে সেই ডিএসইএক্স ৫ হাজার ১৬৯ পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক এক হাজার পয়েন্টের বেশি কমেছে। বাজার মূলধনেও হয়েছে বড় পতন।
বছরের প্রথমদিন ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮০ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। পতনের ধাক্কায় এখন বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ডিএসইর বাজার মূলধন এক লাখ কোটি টাকার ওপরে কমেছে। বাজার মূলধন কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ কমেছে।
এমন পরিস্থিতিতে নতুন বছর ২০২৫ সাল শেয়ারবাজারের জন্য কেমন হবে? এমন প্রশ্ন রাখা হয় ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান আবু আহমেদের কাছে। এর উত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, সামনে যেটা হবে প্রকৃত শেয়ারবাজার হবে। আগের মতো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, জুয়াড়ি হায়ার করে ‘পাম্পিং অ্যান্ড ডাম্পিং’ এগুলো হবে না।
লেনদেন ৩০০ কোটি, ৪০০ কোটি বা ৭০০ কোটি বা তার বেশিও হতে পারে, সেটা হতে হবে প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আইটেম বিক্রি করার মাধ্যমে নয়। আগামী বছর আমরা একটা স্বাচ্ছ শেয়ারবাজার পাবো।
তিনি বলেন, আমাদের কিছু বিনিয়োগকারী চায় রমরমা শেয়ারবাজার। মাথা থেকে ওগুলো ফেলে দিতে হবে। একটা শেয়ারকে ১০০ টাকা থেকে দু-তিন মাসের মধ্যে এক হাজার টাকায় নিয়ে যাওয়া, ওটা মাথা থেকে ফেলে দিতে হবে। ওই ধরনের কোনো শেয়ারবাজার হবে না। যেটা হবে, সেটা সত্যিকার শেয়ারবাজার হবে। ভালো কিছু আইপিও এলে দীর্ঘমেয়াদে মানুষ বিনিয়োগ করতে পারবে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, যে সব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো যদি বাজারবান্ধব হয় এবং সংস্কারগুলো যদি যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যায় তাহলে আমরা আশা করছি আগামী বছর শেয়ারবাজার ভালো হবে। বাজারবান্ধব নীতি সংস্কারের পাশাপাশি বাজারে ভালো আইপিও আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। ভালো কোম্পানির আইপিও আনা সম্ভব হলে বাজারের গভীরতা বাড়বে।
তিনি বলেন, আইপিও প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য হওয়ায় আইপিও কম আসছে। বাজারের গভীরতা বাড়াতে ভালো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির কোনো বিকল্প নেই। ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে পলিসিগত যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর করতে হবে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারে যে অশনি সংকেত তা হলো আস্থার অভাব। সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, এটাই আমাদের মূল প্রত্যাশা। এখন পর্যন্ত আমি আশাবাদী হওয়ার মতো, কিছু দেখছি না। বাজার ভালো হওয়া বা বাজার নিয়ে নতুন আশা সঞ্চার হওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপ কারও কাছ থেকে দেখছি না।
কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে বাজার নিয়ে আশাবাদী হওয়া যায়? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, প্রথমত আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আস্থা ফেরানোর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে উদ্যোগ নিতে হবে। আস্থা ফেরাতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকে সুরক্ষিত করতে হবে। বাজার ভালো করতে হলে মানসম্পন্ন কোম্পানির আইপিও আনতে হবে।
ব্যবসার ক্ষেত্রে ২০২৫ সালের প্রধান চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিবিএ সভাপতি বলেন, ‘প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে রাজনৈতিক সমস্যা। রাজনৈতিক সমস্যা যতদিন সমাধান না হয়, ততদিন অন্য সমস্যা যাবে না। সবগুলো বিষয় রাজনীতির ওপর নির্ভর করে। এই যে শ্রম অসন্তোষ, এটা একটা অর্থনৈতিক বিষয়ের থেকে রাজনৈতিক বিষয় বেশি। তারপর জ্বালানি।
জ্বালানিটা নির্ভর করছে দেশের ফিসক্যাল পলিসি (রাজস্ব নীতি) কী হবে। সেটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পৃক্ত। আমি মনে করি প্রধান সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক সমস্যা। আগামী বছর কেয়ারটেকার সরকার থাকবে, নাকি রাজনৈতিক সরকার আসবে এ বিষয়গুলো পরিষ্কার হওয়া উচিত।
নতুন বছরে বিনিয়োগ পরিস্থিতি কেমন হতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এগুলো নির্ভর করছে সংস্কারগুলোর ওপর। কারণ চার মাস ধরে আমরা বলছি সংস্কার করা হবে। সংস্কারটা হচ্ছে কি না আদৌ এবং যদি হয়, কী সংস্কার হচ্ছে?
বিনিয়োগবান্ধব কি না? এখন তো আর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই, এখন একটাই কর্মসূচি এটা হচ্ছে সংস্কার। এই সংস্কারগুলো কতটুকু, কীভাবে হয় তার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ। সংস্কার যদি না হয় এবং যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে মানুষ আবার হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাবে।