আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রাজনীতির ময়দানে দীর্ঘদিনের বন্ধু হিসেবে পরিচিত বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী। বিভিন্ন দুঃসময়ে পাশাপাশি হেঁটেছে রাজনৈতিক দল দুটি। একসঙ্গেই মোকাবিলা করেছে নানা ক্রান্তিকাল। পরিস্থিতি বিবেচনায় মাঝে-মধ্যে নানা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন দুপক্ষের নেতারা, হয়েছে মান-অভিমানও। তবে কখনো চূড়ান্তভাবে দূরে সরে যায়নি তারা। এবার ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর কাছাকাছি এলেও জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের জন্য ‘যৌক্তিক’ সময়ের কথা বললেও জামায়াতের অবস্থান ভিন্ন।

জামায়াত তাড়াহুড়া না করে সংস্কারের জন্য অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায়। এসব ছাড়াও এখন আরো কিছু ভিন্ন ইস্যু এতে যোগ হয়েছে। চলছে নেতাদের বাহাস। ফলে একাধিকবার ভোটের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব ক্রমশই বাড়ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে দল দুটির দ্বন্দ্ব এখন স্পষ্ট। আর সেই দ্বন্দ্ব থেকেই দুই দলের শীর্ষনেতারা একে অপরের প্রতি করছেন কটাক্ষ।

আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য ২০২৫ সালের চেয়ে বেশি সময় দিতে নারাজ বিএনপি। এজন্য যতটুকু সংস্কার না হলেই নয় ততটুকু সংস্কার করেই নির্বাচন দেয়ার দাবি তাদের। কিন্তু নির্বাচন আয়োজনের জন্য অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে আরও বেশি সময় দিয়ে চায় জামায়াতে ইসলামী। তাদের বক্তব্য: প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করেই নির্বাচন হোক।

নির্বাচন নিয়ে এই মতবিরোধের জেরেই গত রোববার প্রকাশ্য এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীকে মোনাফেক বলেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিবৃতি দিয়ে তার কথার প্রতিবাদ জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। পাল্টা বিএনপিকে মোনাফেক বলেছেন তিনি।

শুধু রুহুল কবির রিজভী নয়, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাই জামায়াতে ইসলামীর এখনকার ভূমিকা নিয়ে সন্দিহান। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকা টাইমসের সাথে কথা বলার সময় প্রশ্ন তোলেন, বিএনপি মোনাফেক হলে ২০১৮ সালে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলো কিভাবে? তিনি বলেন, এই জামায়াতে ইসলামীই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গী হয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তারাই আবার ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮ সালে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করেছে। বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে তারা পায় ১৮ থেকে ২০টি আসন, আর একা নির্বাচন করলে পায় তিন থেকে চারটি আসন।

শামসুজ্জামান দুদু আরও বলেন, ’২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে পতিত স্বৈশাসককে মাফ করে দেওয়ার কথা বলেছে জামায়াতে ইসলামী। শহীদের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই তারা আপোষ করতে চেয়েছিল। একাত্তরে শুধু স্বাধীনতার বিরোধীই ছিলোনা, পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্রও ধরেছিল। তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমাও চায়নি। আসলে জামায়াতই জামায়াতের জন্য ভয়ঙ্কর বলে মন্তব্য করেন শামসুজ্জামান দুদু।

অন্যদিকে চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে জামায়াতের যেহেতু একটি ক্ষত রয়েছে, সে হিসেবে নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের অবস্থান পরিস্কার করা উচিত ছিলো। কূটকৌশল করে স্থায়ী কিছু পাওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে এই জামায়াতকে কাছে রাখার অপরাধে বিএনপিকেও অনেক কাফফারা দিতে হয়েছে। দেশ-বিদেশে অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়েছে। আমাদের সঙ্গে রাজপথে ছিল, ক্ষমতায় আসার পরও আমরা জামায়াতকে ক্ষমতার অংশীদারত্ব করেছিলাম। বিএনপি অকৃতজ্ঞ দল নয়। একেক সময় একেক বন্ধু তৈরি করা বিশ্বস্ততার কাজ নয়।

অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের এমন সব বক্তব্যকে জামায়াতে ইসলামীর প্রতি অসত্য বিষোদগার বলে মন্তব্য করেন দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ। তিনি বলেন, বিএনপি যে অভিযোগগুলো করছে তা সঠিক কিনা বুঝতে হবে। জামায়াত তো বিএনপির বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। ৫ আগষ্টের পর থেকে দখলবাজি করেছে এই বিএনপি। তাদের চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই অপরাধে অনেককে বহিষ্কারও করেছেন।

রিজভী সাহেব জামায়াত নিয়ে গুরুতর মিথ্যাচার করেছেন। স্বাধীনতার বিরোধিতা করা, মোনাফেক, রগকাটাসহ অনেক তকমা দিয়েছেন যা জামায়াত করে না। এরআগেও বিএনপি জামায়াতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে, তবে এতে বিএনপি লোকসান হয়েছে বলে জানান মতিউর রহমান আকন্দ। আর জামায়াতের বিরুদ্ধে এখনকার কথাবার্তায় খোদ বিএনপির অনেক নেতাই ক্ষুব্ধ বলে দাবি করেন জামায়াতের এই নেতা।

দুই দলের এই বাদানুবাদ নিয়ে কোন মতামত দিতে রাজি হননি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ গোলাম পরওয়ার। বিষয়টি বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হবে বলে জানান ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। আর গোলাম পরওয়ার বলেন, এনিয়ে জামায়াত থেকে দেওয়া বিবৃতিই তার দলের সবার কথা।