ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় ‘শুভংকরের ফাকি’, সুফল মিলবে কী পুঁজিবাজারে
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যাংকে তারল্য সংকট, খেলাপি ঋণের উচ্চ বোঝা ও ভয়াবহ আর্থিক কেলেংকারির মধ্যেও পরিচালন মুনাফা বেড়েছে বলে দাবি করেছে অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক। বিষয়টিকে কেউ বলছেন, ‘জোক অব দ্য ইয়ার’। আবার কেউ বলছেন, শুভংকরের ফাঁকি। বিশ্লেষকদের মতে, এটা কৃত্রিম উপায়ে দেখানো হয়েছে। গ্রাহক আকর্ষণের একটা হাতিয়ার। তারা বলেন, বিদায়ী বছরে ব্যাংকিং খাতের যে আচরণ ছিল তার সঙ্গে মুনাফার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মুনাফায় চলছে শুভঙ্করের ফাঁকি। নানা কারসাজির মাধ্যমে কিছু ব্যাংক মুনাফাকে স্ফীত করছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য কৃত্রিমভাবে ভালো দেখিয়ে উদ্যোক্তা পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডাররা উচ্চ মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। এর ফলে ঝুঁকি বাড়ছে আমানতকারীদের। ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফায় শুভংকরের ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। প্রচলিত নিয়মের আওতায় সুদ আদায় না করেও সেগুলো আয় খাতে দেখানো হয়েছে। খেলাপি ঋণকে নিয়মিত হিসাবে দেখানো হয়েছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথাযথ প্রভিশন সংরক্ষণ না করে সেই অর্থকে মুনাফা হিসাবে দেখানোর নজির রয়েছে। এভাবে ফুলেফেঁপে মুনাফা দেখানো হলেও বাস্তবে অর্জিত মুনাফার পরিমাণ খুবই কম।
ফলে সমাপ্ত বছরে আর্থিকভাবে সবল থাকা ব্যাংকিং খাতের বেশ কিছু কোম্পানির পরিচালন মুনাফার উলম্ফন হয়েছে। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি কিংবা পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব না পড়লেও এর সুফল ঘরে তুলে নিয়েছে বেশকিছু ব্যাংক। কারণ অস্বাভাবিক এ মুনাফার পেছনে রয়েছে ‘শুভংকরের ফাকি’।
মুলত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলে দফায় দফায় ঋণের সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নীতি সুদহার (রেপো রেট) ৫ থেকে বাড়িয়ে উন্নীত করা হয় ১০ শতাংশে। ব্যাংক ঋণের সুদহারও সর্বোচ্চ ৯ থেকে বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ১৬ শতাংশে ঠেকেছে। সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের এ প্রেসক্রিপশন দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বহুজাতিক দাতা সংস্থাটির এ প্রেসক্রিপশন মানতে গিয়ে দেশে বেড়ে গিয়েছে ‘কস্ট অব ডুইং বিজনেস’ বা ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না এসে উল্টো আরো উসকে উঠেছে। এছাড়া অনেক ব্যাংক এখনওপ্রভিশনিং সম্পন্ন করেনি। তারা প্রভিশনিং সম্পন্ন করলে পুরো ব্যাংক খাতের আসল চিত্র ফুটে উঠবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সুদ হার বাড়ানোর কারণে কিছু ব্যাংকের মুনাফা বাড়লেও সামগ্রিক অর্থনীতি কিংবা পুঁজিবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অতিরিক্ত সুদহারের কারণে মানুষ এখন ব্যাংক ও সরকারি ট্রেজারি বিল, বন্ডসহ ফিক্সড ইনকাম করা যায় এমন জায়গায় বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। অনেকেই পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উঠিয়ে নিয়ে এসব জায়গায় বিনিয়োগ করছে। আর এখনও অনেক ব্যাংক প্রভিশনিং সম্পন্ন করেনি। তারা প্রভিশনিং সম্পন্ন করলে পুরো ব্যাংক খাতের আসল চিত্র ফুটে উঠবে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, সুদ হার বাড়ানোর কারণে ব্যাংকের মুনাফা বাড়ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না। বিনিয়োগকারীরাও শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শুধু ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। পাশাপাশি ট্রেজারি বিল বন্ডে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ব্যাংকের মুনাফা বাড়লেও সুদ হার বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীদের লোকসান বেড়েছে। ফলে বেকারত্বও বাড়ছে। সামগ্রিক অর্থে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বিশিষ্ট বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ এ হাফিজ বলেন, মূল্যস্ফীতি যখন মানুষের নাগালের বাহিরে চলে যায় তখন সেটি দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে গেছে। সুদ হার বাড়ানোর কারণে ব্যবসায়ীরা লোকসান করছে। তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে মানি সার্কুলেশন কমিয়ে আনা উচিত ছিল। মূল্যস্ফীতি হওয়ার এটি একটি বড় কারণ।
অনেক ব্যাংক মন্দ ঋণে জর্জড়িত। তারা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা সরবরাহ করতে পাচ্ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের মাধ্যমে বাজারে মানি সার্কুলেশন বাড়িয়েছে। এতে করে মূল্যস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেছে। এসব ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা উচিত হয়নি। বরং যারা এসব ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা ফেরত দেয়নি তাদের ব্যাপারে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।
এম এ হাফিজ আরও বলেন, একদিকে সুদ হার বাড়ানো হচ্ছে। আবার অন্য দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকে মানি সার্কুলেশন বাড়িয়েছে। এভাবে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতি কমায় নিয়ে আসতে হবে। সুদ হার কমায় নিয়ে আসতে হবে। আয় বাড়াতে হবে। আর আয় বাড়লে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এমনিতেই বেড়ে যাবে। গত বছরের তুলনায় ব্যাংকগুলো পরিচালনা চার্জ বাড়িয়েছে। এসব চার্জ তারা মুনাফা দেখিয়েছে। অনেক ব্যাংক মন্দ ঋণের উপর প্রভিশনিং করেনি। যে কারণে এসব ব্যাংকের পরিচালনা মুনাফা বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতে সুদহার বাড়লে তা পুঁজিবাজারের জন্য কখনোই মঙ্গলজনক হতে পারে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত শুধুমাত্র ব্যাংকিং খাত নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৪ সালে আর্থিকভাবে সবল থাকা প্রায় সব ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। কোনো কোনো ব্যাংকের মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে শতভাগেরও বেশি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬টি ব্যাংকের মধ্যে ১২টি ব্যাংকের সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালের পরিচালন মুনাফা রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মুনাফার তথ্য পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো: ওয়ান, ব্র্যাক, সিটি,
ডাচ-বাংলা, প্রাইম, ব্যাংক এশিয়া, ইস্টার্ন, এক্সিম, এমটিবি, শাহজালাল, মার্কেন্টাইল ও প্রিমিয়ার ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মধ্যে পরিচালন মুনাফা প্রবৃদ্ধির দিক এগিয়ে রয়েছে ওয়ান ব্যাংক। এর পরিচালনা মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৩০ শতাংশ। এরপর রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক ৭২ শতাংশ এবং সিটি ব্যাংক ৬৯ শতাংশ। কেবল ২০২৪ সালে প্রিমিয়ার ব্যাংকের মুনাফা কমেছে।