ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে যেন মরণফাঁদ
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের একমাত্র এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ২০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। মহাসড়কটি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর থেকে মহাসড়কটিতে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। কথা ছিল, এটি রাজধানীতে যাতায়াত সহজ করবে। কিন্তু তা না করে উল্টো এই এক্সপ্রেসওয়ে পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে।
উদ্বোধনের পর ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে ৭৯টি দুর্ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত হয়। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৫ জন, গুরুতর আহত হয়েছেন ৬৭ জন। ২০২২ সালে দুর্ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত হয় ১৯৬টি, এতে ৭৪ জন নিহত ও ২৬৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। ২০২৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৪টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৮৫ জন আহত হয়েছেন। মারা গেছেন ২২ জন। যার মধ্যে চলতি ডিসেম্বরেই মারা গেছে ১০ জন।
হাইওয়ে পুলিশের তথ্যানুসারে, গত সপ্তাহে এই এক্সপ্রেসওয়েতে অন্তত তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। কেউ কেউ বলছেন, কিছু ঘটনা রিপোর্ট করা হয়নি। ফলে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে। এছাড়া গত এক বছরে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৮৫ জন। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরেই মারা গেছেন ১০ জন।
অন্যদিকে ঢাকার পূর্বাচলে কুড়িল-কাঞ্চন এক্সপ্রেসওয়েতে (যা ৩০০ ফিট সড়ক বলে পরিচিত) গত এক মাসে ১০ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় সাধারণত পরিবহন চালকদের অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে।
তবে পরিবহন খাত বিশেষজ্ঞ, হাইওয়ে পুলিশ ও বাংলাদেশ বাসমালিক সমিতির নেতাদের মতে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই এক্সপ্রেসওয়েতে সড়ক অবকাঠামো খাতে বড় গাফিলতি করা হয়েছে। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এআরআইয়ের দুই শিক্ষক বলেছেন, এক্সপ্রেসওয়েতে নিরাপদ গাড়ি চলাচলের নিয়ামকগুলো নিশ্চিত না করায় দুর্ঘটনার হার কমছে না।
দেশের দুই প্রধান এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা ও কুড়িল-কাঞ্চনে সড়ক ব্যবস্থাপনার আরও কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে বলে মনে করেন বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক ড. শামছুল হক। তিনি বলেন, ‘বেশ কিছু জায়গায় অপারেশনাল ডেফিসিয়েন্সি রয়ে গেছে। বিগত সরকার এক্সপ্রেসওয়ের গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তবে এখানে প্রতিবেশের বিষয়টি মোটেই চিন্তা করা হয়নি। এক্সপ্রেসওয়ের স্ট্যান্ডার্ড গতিসীমা প্রতি ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার হলে ঠিক আছে।
কিন্তু ঘন কুয়াশায় যখন দৃষ্টিসীমায় কিছুই ধরা দেয় না, তখন তার গতি কোন মাত্রায় কমিয়ে এনে গাড়ি চালাতে হবে সেটি কিন্তু চালককে কেউ বলে দেয় না। এক্সপ্রেসওয়েতে সাইন মার্কিংগুলো ঠিকমতো দেখা যায় না অনেক সময়।’ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জাতীয় তদন্ত কমিটির সদস্য ও এআরআইয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক বলেন, ‘ভাঙ্গা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে সড়কের নকশা এমন যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গতি বেড়ে যাচ্ছে।
চালকরা চাইলেও গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কিছু জায়গায় ছোট ছোট কালভার্ট আছে, সেখানে এক্সটেন্ডেড কার্ব না থাকার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। ইন্টারসেকশন পয়েন্টে ফিডার রোডগুলোকে এমনভাবে কানেক্ট করে দেওয়া হয়েছে, যে এই সড়ক থেকে আসা ছোট যানবাহনগুলো প্রধান সড়কের যানবাহনকে প্রাধান্য দিতে চাইলেও পারছে না। মেইন রোডে উঠে আসার পর ছোট যানবাহনগুলো এক্সপ্রেসওয়েতে কীভাবে চলবে, এমন কোনো সাইন, মার্কিং নেই। বিভিন্ন গতির যানবাহন কীভাবে গতি নিয়ন্ত্রণ করবে, এসব নিয়ে ট্রাফিকের নিয়মাবলিও চালকরা জানতে পারছেন না।
হাইওয়ে পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দিন খানও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, এত টাকা খরচ করে আমরা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করেছি। এখানে কোনো দুর্ঘটনা হলে সাধারণত আমরা বাসচালকদের দায়ী করছি, পুলিশকে দায়ী করছি। কিন্তু এখানে সড়ক অব্যবস্থাপনা দায়ী। ত্রুটিযুক্ত রাস্তার কারণেও ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। এখন এসব অবকাঠামো ভেঙে যদি নির্মাণ করতে হয়, তাহলে আবারও জনদুর্ভোগ শুরু হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশের বিদ্যমান সড়ক কাঠামোতে এক্সপ্রেসওয়ে একটি বিলাসী প্রকল্প। আগে আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলায় আনা দরকার ছিল। জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়কে কোন গতির যানবাহন চলবে, সার্ভিস লেন কীভাবে থাকবে, তাই আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি। তার মধ্যে অধিক গতিসম্পন্ন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করে দিলে সেখানে বিশৃঙ্খলা হওয়া স্বাভাবিক।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙা এক্সপ্রেসওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক নিয়ামক খুঁজে পান বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শামছুল হক। বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)-এ তিন অধিদপ্তরের কাজে সমন্বয়হীনতাকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
শামছুল হক বলেন, ‘সড়কে যেকোনো দুর্ঘটনা হলে আমরা সরাসরি বাস চালক বা লরি চালককে দায়ী করি। কিন্তু এই বাসচালক দক্ষ কি না, তার বাসটির ফিটনেস সনদ, রুট পারমিট আছে কি না, সেসব কারা মনিটর করছে? বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ তারা কি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন? একজন চালক যে কি না সড়কে সাইন-সিগন্যাল ঠিকমতো বুঝতে পারেন না, তাকে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া বাস মালিক সমিতিরও দায় রয়েছে।
দায় রয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরেরও (সওজ)। কারণ এক্সপ্রেসওয়েজুড়ে কোথায় গতিরোধক রাম্বল স্ট্রিপ দিতে হবে, কোথায় হাম্প-বাম্প দিতে হবে সেটি অনেক সময় তারা ভুল করে ফেলে। এক কথায় এনফোর্সমেন্টের জায়গায় যে ঘাটতি রয়ে গেছে, এসবই এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।’
বিআরটিএতে চালকের লাইসেন্স সনদ, যানবাহনের ফিটনেস সনদ জালিয়াতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। অদক্ষ চালককে অর্থের বিনিময়ে সনদ পাইয়ে দিতে বাস মালিক সমিতি ও বিআরটিএ কর্মকর্তা, কর্মচারীদের যোগসাজশের প্রমাণ মিলছে অহরহ। এমন পরিস্থিতিতে যানবাহনের ফিটনেস সনদ সেবা বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি ড. শামছুল হক। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে দেশে গাড়ি চলত ১৬ লাখ, এখন চলে ৫৬ লাখ। এত বিপুলসংখ্যক গাড়ির ফিটনেস সেবা বিআরটিএর পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।
এ সেবাটি যত দ্রুত সম্ভব আউটসোর্সিংয়ে দিয়ে দিতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে এমন উদাহরণ রয়েছে। বেসরকারি কোম্পানিকে এ কাজের ভার দেওয়ার আগে বিআরটিএর কাছে তাদের কাজের স্বচ্ছতা ও দায়ভারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কথা প্রসঙ্গে তিনি দেশের এক্সপ্রেসওয়েগুলোতে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমানোর জন্য ‘ফরগিভিং ডিজাইন’ তত্ত্ব প্রয়োগের পরামর্শ দেন। ‘ফরগিভিং ডিজাইন’ মানে হলো দ্রুতগতির মহাসড়কের জন্য প্রশস্ত বাধাবিহীন রাস্তা তৈরি করা।
এই বিষয়ে বিআরটিএর উপপরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) হেমায়েত উদ্দিন জানান, বিআরটিতে এখন ম্যাজিস্ট্রেটের সংকট রয়েছে। হাইওয়ে এবং এক্সপ্রেসওয়েতে গতিসীমা পরিমাপ করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল নেই। সে ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি পরিচালনা করায় সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করছেন ম্যাজিস্ট্রেটরা।
রাজধানীর মিরপুরে বিআরটিএ বিভাগীয় কার্যালয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ম্যাজিস্ট্রটদের অভিযান শুরু করা হবে। ম্যাজিস্ট্রেটদের অভিযানের প্ল্যান করা হচ্ছে। বাস ড্রাইভার ও কন্ট্রাক্টরদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা হবে। বুয়েট অধ্যাপক শামছুল হক বিআরটিএর সেবাকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার যে কথা বলেছেন, এ নিয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গত ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোলপ্লাজায় ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনায়। টোল দিতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলকে চাপা দেয় কুয়াকাটাগামী ব্যাপারী পরিবহনের একটি বাস। এতে প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এতে প্রাইভেট কারে থাকা একই পরিবারের ৪ জনসহ ৬ জন মারা যান। গত বুধবার ভোরে এক্সপ্রেসওয়ের ভাঙ্গা উপজেলার চান্দ্রা ইউনিয়নের পুলিয়া এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয় ঢাকাগামী পূর্বাশা পরিবহনের যাত্রীবাহী একটি বাস। এতে নিহত হন ট্রাকচালক নুর আলম ও যাত্রীবাহী বাসের চালকের সহকারী কাদের মিয়া।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন দুর্ঘটনায় আরও চারজন প্রাণ হারিয়েছেন। হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে নিমতলী এলাকায় একটি কাভার্ডভ্যানের পিছনে মাওয়ামুখী আব্দুল্লাহ পরিবহনের মিনিবাস ধাক্কা দেয়, এতে দুমড়ে-মুচড়ে যায় মিনিবাসটি। এ সময় নিহত হয় বাসের হেলপার মো. জীবন (৪৪), বাসযাত্রী মো. রায়হান (২৭)। গতকাল শুক্রবার ভোরে এক্সপ্রেসওয়ের হাসাড়া এলাকায় নিহত হন আরও ২ জন। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি।
ধলেশ্বরী টোলপ্লাজায় দুর্ঘটনায় বাসমালিক ডাবলু ব্যাপারী ও বাস চালক মো. নুরুদ্দীনকে জেলহাজতে পাঠিয়েছেন আদালত। পরে জানা যায়, ব্যাপারী পরিবহনের ওই বাসের চালক নুর উদ্দিন মাদকাসক্ত ছিলেন।
পরিবহন চালকদের মাদকাসক্ত হওয়া নিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারাও উদ্বিগ্ন বলে জানান ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম। তিনি জানান, মাদকাসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে প্রতি ১৫ দিন অন্তর বাসমালিকরা চালক ও অন্য শ্রমিকদের নিয়ে কাউন্সেলিং করছেন। চালকদের চাঙা রাখতে তাদের জন্য বিশ্রাম ও বিনোদনের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত রাখতেও সুপারিশ এসেছে।