পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিন
ফাতিমা জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ২০১০ সালের বিপর্যয়ের পর পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা ও বিনিয়োগে অচলাবস্থার বিষয়টি কারও অজানা নয়। এর পর থেকে বহু বিনিয়োগকারীই কিন্তু খারাপ সময় পার করছেন। আর পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুঁজিবাজার। ফলে গত শুক্রবার দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণে ‘পুঁজিবাজারে কোন ভাবেই আস্থা ফিরছে না, নেই কার্যকর উদ্যোগ’ শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এতে পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতার চিত্রই ফুটে ওঠে। খবরেই বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আনতে নতুন অর্থের সরবরাহের পাশাপাশি একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বিএসইসিও কারসাজি রোধে একাধিক কোম্পানি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। তা সত্ত্বেও স্বাভাবিক হচ্ছে না পুঁজিবাজার। এমনকি মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারদরেও অস্থিরতা চলছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়। অবশ্য এজন্য বাজারের প্রতি আস্থাহীনতাকেই দায়ী করছেন বিনিয়োগকারীরা। এদিকে আইন মেনেই সবকিছু করা হচ্ছে বলে দাবি নিয়ন্ত্রক সংস্থার। এরপরও আস্থা না ফেরার বিষয়টি কিন্তু বেশ হতাশার।
এদিকে ২০১০ সালে ধসের ১৫ বছর পরও বিনিয়োগকারীর কাছে এখনো আস্থাহীন দেশের পুঁজিবাজার। এখনো এটি পুঁজি হারানোর বাজার। ভালো-মন্দ বেশির ভাগ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেও লাভের দেখা মিলছে না। তাই বাজারে আসতে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থ ও পুঁজিবাজারসহ সব খাতেই সংস্কারে হাত দেয়।
এর অংশ হিসেবে সরকার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেও (বিএসইসি) সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে। গত ১৮ জুলাই সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়। নিয়োগর পর আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই ৫ মাস অতিবাহিত হলেও কার্যকরী কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। নতুন যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেটা নিয়ে সমালোচনায়ই বেশি হয়েছে এবং বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না পুঁজিবাজারে।
বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল, দীর্ঘকাল পতনের বৃত্তে আটকে থাকা পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে নতুন সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন নেতৃত্বের হাত ধরে। কিন্তু দেশের পুঁজিবাজার এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। দেশে কভিডের সময় পুঁজিবাজার ৩ হাজার ৬০০ পয়েন্টে নেমে এসেছিল। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা যায়।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স ৭ হাজার ৩০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। তবে এর পর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট, ডলার সংকট এমন নানা কারণে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে পুঁজিবাজার। সময়ের পরিক্রমায় কখনো ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেলেও তা দীর্ঘমেয়াদে বজায় রাখা সম্ভব হয়নি।
টানা দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এতে বিনিয়োগ অনেকটাই নিস্কিয় অবস্থায় রয়েছে। আবার বাড়তি সুদহারের কারণেও পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ সরে যাচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, একসময় পুঁজিবাজার কারসাজির কারণে জাঙ্ক শেয়ারে বিপুল বিনিয়োগ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। এসব শেয়ারের দাম কমায় বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তারা। আবার বিপুল অর্থ হাতে নিয়ে মাঠে নামা কারসাজি চক্রও তাদের টাকা তুলে নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানা যায়। এসবের সমন্বিত প্রভাবে বাজারে তারল্য প্রবাহ কমেছে।
অন্যদিকে জাঙ্ক শেয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেকে মার্জিন ঋণ নিয়েছেন। এ অবস্থায় শেয়ারের দাম কমার কারণে মার্জিন ঋণ নেয়া বিনিয়োগকারীরা বেশি আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ফোর্স সেলও হচ্ছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে তাদের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে শেয়ার বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে পুঁজিবাজারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পুঁজিবাজারে করতে সুশাসন বহাল করা যেমন জরুরি তেমনি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো জরুরি হবে। এজন্য পুঁজিবাজারের দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করার পাশাপাশি বিএসইসিকে তৎপর হতে হবে।
বিগত সরকারের ১৫ বছর মেয়াদে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো পুঁজিবাজারেও অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। অসংখ্য দুর্বল ও প্রায় অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করে পুঁজিবাজারের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল মৌলভিত্তির, জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ফ্লোর প্রাইস আরোপ, সার্কিট ব্রেকারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমায় বেঁধে দেয়া ইত্যাদি নানা কৃত্রিম ব্যবস্থায় বাজারের এ অবস্থা ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। বিএসইসি গঠিত পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭টি। আশা করা যায়, বাজারের স্বার্থে যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারের অবস্থার উন্নতি হবে। ফাতিমা জাহান, প্রধান সম্পাদক, দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ