নির্বাচন ইস্যুতে ইউনূস সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বিএনপি, টার্গেট ডিসেম্বর
আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বিএনপি। চলতি বছরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাইছে তারা। বিএনপির দাবি, চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়েই এই নির্বাচন করা সম্ভব। তাদের মতে, নির্বাচনে দেরি হলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, ২০১৮’র রাতের ভোট এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়েছে দেশের মানুষ। আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের ক্ষোভের অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে এটিও ছিল অন্যতম।
৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগকে বিতাড়িত করার পর তাই দেশের মানুষ একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও জানিয়েছেন এবারের নির্বাচন হবে স্মরণকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুষ্ঠু নির্বাচন। তবে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে অন্তর্র্বতী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য ফুটে উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে চলতি বছর ডিসেম্বর কিংবা আগামী বছরের মাঝামাঝি নির্বাচনের সম্ভব্য সময় হিসেবে জানানো হয়েছে।
আর বিএনপিসহ তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সকল রাজনৈতিক দল যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচন দাবি করে আসছে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলটি ইতোমধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে। নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে নির্বাচন আদায়েও সোচ্চার হয়ে উঠেছে বিএনপি। এলক্ষ্যে ইতোমধ্যে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছে। প্রয়োজনে সরকারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি কর্মসূচিতে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন এসব বৈঠকে উপস্থিত নেতারা।
বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর নেতারা বলেন, বর্তমান সরকার সার্বিক পরিস্থিতি ঠিকভাবে সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এতো দিনেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। এছাড়া সরকারের ভেতরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসরদের কারণে গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ একের পর এক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এছাড়া অনির্বাচিত ও দুর্বল সরকার হওয়ার কারণে নানা ধরণের দাবি-দাওয়া ও আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তো আছেই। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দ্রুত একটি নির্বাচন প্রয়োজন।
চলতি বছরের শেষ দিকে অথবা আগামী বছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে নির্বাচন হতে পারে বলে জানিয়েছেন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করার পরেই নির্বাচন করতে চাইছেন তিনি। তবে নির্বাচনের জন্য এতটা সময় সরকারকে দিতে চাইছে না বিএনপি। কেন তারা চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাইছেন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব। মির্জা ফখরুল বলেন, চলতি বছরের জুলাই বা আগস্ট মাসেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব। এই নির্বাচন করতে যত দেরি হবে, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে তত বেশি সংকট তৈরি হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নই ওঠে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, জনগণের আগ্রহ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। তাই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন নয়। কারণ স্থানীয় সরকার দেশ পরিচালনা করে না। দেশ চালায় সংসদ। সংস্কারের পরে দু’টি নির্বাচন এক সঙ্গে করতে গেলে জাতীয় নির্বাচনের আরও দেরি হবে।’ বিএনপির দাবি, নির্বাচন করতে বেশি সময় লাগবে না। যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা চলমান প্রক্রিয়া। এর জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চিন্তা যুক্তিযুক্ত নয় বলেও জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল।
জানা গিয়েছে, সংসদের নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা নিয়ে পরিকল্পনা করছে অন্তর্র্বতী সরকার। তারপরেই গত সোমবার রাতে একটি বৈঠকে বসে বিএনপি। সেখানেই চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব বলে জানান বিএনপির নেতারা।
নির্বাচন কমিশনের সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া সময় অনুযায়ী আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। এ দিকে, বাংলাদেশে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে ভ্যাট এবং অন্যান্য কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। এরই সমালোচনা করেছে খালেদা জিয়ার দল। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও এ দিন জানিয়েছে তারা। এদিকে নির্বাচনের দাবির পাশাপাশি বিএনপির হাইকমান্ড ইতোমধ্যে দলের নেতাকর্মীদের যার যার এলাকায় মানুষের মন জয় করতে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদেরও জানিয়ে দেয়া হয়েছে এবার ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেবে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ এবং সবার মনে প্রশ্ন আছে ও আলোচিত হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে- নির্বাচন। কবে নির্বাচন হতে যাচ্ছে? আমাদের পক্ষ থেকে আমরা যেটা বলে আসছি, এই বছরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। অন্য কোনো ভাবনার দিকে না গিয়ে সরাসরি জাতীয় নির্বাচনের দিকে গিয়ে দেশে আগামীদিনে একটা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য।
তিনি বলেন, অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি দেশ বেশিদিন চলতে পারে না। অগণতান্ত্রিক সরকারের রাজনৈতিক ওয়েট থাকে না, মবিলাইজেশন প্রসেস থাকে না, জনগণের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকে না। জনগণের কাছ থেকে কোনো ফিডব্যাক পাওয়া যায় না। সুতরাং একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যত তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব সেদিকে আমরা জোর দিচ্ছি। দ্রুত নির্বাচন ইস্যুতে শরিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএনপি। এসব বৈঠকে জোট ও দলের নেতারাও নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির সাথে ঐক্যমত প্রকাশ করেছে।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেন, অন্তর্র্বতী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের এখন মূল বিষয় হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা হবে। আমরা সংস্কার চাই। তবে সংস্কারের কোনো আলামত দেখছি না। গত ৬ মাসে কোনো দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।
জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার বিদায় নিয়েছে সত্য, কিন্তু নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। হাসিনা সরকারের প্রেতাত্মারা এখনো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজ করছে এবং নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি করছে। কতগুলো নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে রাজনীতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেখানে জাতীয় নির্বাচনের বিষয় সামনে আসার কথা, তা না এনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা কেন সামনে আনা হচ্ছে। কার স্বার্থে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয় সামনে আসছে। জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হলে নতুন করে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের ডালপালা গজাবে।