শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অত্যাধুনিক সার্ভিলেন্স সফটওয়্যারের দুর্বলতায় কারসাজি করে পার পেয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেট। কারসাজিকারীরা সহজেই বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন করতে পারছে। এতে তারা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। একটি সম্প্রতি দেশের পুঁজিবাজারে রূপকথার আলাদিনের চেরাগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে কাগজ ও মুদ্রণ খাতের প্রতিষ্ঠান খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। কোম্পানিটি শেয়ার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলেছে।

অথচ ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারে আস্থা সংকটে বিনিয়োগকারীরা। গত এক মাসের ব্যবধানে ৭ টাকায় শেয়ার সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে ২১ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। এদিকে সম্প্রতি খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের কারখানা বন্ধ পেয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) পরিদর্শন দল। ডিএসই জানিয়েছে, সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে ডিএসইর পরিদর্শন দলটি খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের কারখানাটি বন্ধ পেয়েছে।

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটির শেয়ার দর গত কিছুদিন যাবত অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় ডিএসই কোম্পানিটির কাছে একাধিকবার কারণ জানতে চিঠি পাঠায়। কিন্তু কোম্পানিটি ডিএসইর কোনো চিঠিরও জবাব দেয়নি। তবে সম্প্রতি পরিদর্শন গিয়ে দলটি কারখানাটি তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পায়। কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতে ডিএসই তা প্রকাশ করে।

গত কয়েক বছর ধরে লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড। অথচ কোম্পানিটির শেয়ার দর ছুটছে লাগামহীনভাবে। সর্বশেষ এক মাসে কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় ৩ গুনের বেশি। শেয়ার দরের এমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে কারসাজি চক্রের ইন্ধন। শীর্ষ একটি ব্রোকারেজ হাউজ থেকে কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। এসব কারসাজি চক্র থেকে দূরে থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

বাজারে গুজব রয়েছে, কারসাজি চক্রের মুল হোতা একটি সিন্ডিকেট চক্র মিলে এ শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে মেতে উঠছেন। বিষয়টি তদন্ত করলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। এর আগেও এ সিন্ডিকেট চক্রটি বিভিন্ন শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে জড়িত ছিলেন। তবে লোকসানের কারণে গত কয়েক বছর ধরে লভ্যাংশ পাচ্ছে না খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের বিনিয়োগকারীরা। অথচ তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটির শেয়ার দর ছুটছে লাগামহীন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্র মতে, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের শেয়ার দর অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কারণে কোম্পানিটিকে শোকজ করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। মুলত শেয়ার দর বৃদ্ধি নিয়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কাছে কারণ জানতে চেয়ে ব্যাখ্যা তলব করেছে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। ডিএসইর ব্যাখ্যা তলবের উত্তরে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কোনো রকম অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই তাদের শেয়ারটির দর এভাবে বাড়ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোম্পানিটির নানা আর্থিক অনিয়মের দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নির্দেশে ২০২১ সাল থেকে কোম্পানিটির ব্যাংক হিসাব জব্দ রয়েছে। কিন্তু শেয়ারের দরবৃদ্ধিতে কোম্পানির কার্যক্রমের কোনো প্রভাবই নেই। তাই কোম্পানিটির এমন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অনেকের মনে। তাঁরা বলছেন, বন্ধ একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। ফলে কারসাজিকারকেরা ইচ্ছেমতো শেয়ারটির দাম বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে। কারসাজি ছাড়া বন্ধ এ কোম্পানির শেয়ারের দাম এভাবে বাড়ার আর কোনো কারণ নেই। এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি থামাতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৩০ ডিসেম্বর খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের শেয়ার দর ছিল ৮ টাকা ৫০ পয়সা। যা আজ ২১ জানুয়ারি লেনদেন হয়েছে ২২ টাকায়। ডিএসইর তথ্য মতে, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে লেনদেন করছে। কোম্পানিটির মোট ৭ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার রয়েছে। অনুমোদিত মূলধন ১০০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ৭৩ কোটি ৪ লাখ টাকা। পুঞ্জীভূত লোকসান রয়েছে ৮৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। মোট শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ শেয়ার। আর প্রাতিষ্ঠানিক ১ দশমিক ১১ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে বাকি ৫৯ দশমিক ১৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

সূত্র মতে, এনবিআরের মামলার জেরে দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (কেপিপিএল)। উৎপাদনে না থাকলেও পুঞ্জীভূত ঋণের সুদের কারণে কোম্পানিটির দায় বাড়ছে। কর ফাঁকি, জরিমানা, কাস্টমসের পাওনা, ব্যাংকঋণের কিস্তি ও অন্য খরচ মিলিয়ে কোম্পানিটির দায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্লাস্টিকের প্যাকেজিং পণ্য উৎপাদন ও লেবেল প্রিন্টিং এবং সরবরাহকারী কোম্পানি খুলনার লকপুর গ্রুপের কেপিপিএল। ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে কোম্পানিটি। রফতানিমুখী পণ্যের মোড়কের জন্য প্লাস্টিকের লেবেল, প্লাস্টিক ও কাগজের মোড়ক তৈরি, সব আকারের কার্টন বক্স তৈরি, খাদ্য, মাছ বিশেষত সামুদ্রিক মাছ প্যাকেট করার জন্য সব আকারের কার্টন তৈরি করে কোম্পানিটি। মূলত গ্রুপের অন্য কোম্পানির চাহিদা পূরণের জন্যই কাজ করত কেপিপিএল। স্থানীয় বাজারেও কিছু পণ্য বিক্রি করে কোম্পানিটি।

তালিকাভুক্তির পর ২০১৫ সালে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্রায় ২৭১ কোটি ৭২ লাখ টাকা কর ফাঁকি ও বন্ড সুবিধা নিয়ে উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে বেশি কাঁচামাল আমদানির অভিযোগ আনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর না দেওয়ায় কোম্পানির সব ওয়্যারহাউজ সিলগালা ও বন্ড লাইসেন্স বাতিল করে এনবিআর। এতে কোম্পানিটির প্রায় ৫৩ কোটি টাকার কাঁচামাল আটকে যায়। অন্যদিকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষও প্রায় ৫৪ কোটি টাকার আমদানি পণ্য আটকে দেয়।

এনবিআরের অবস্থানের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে পণ্য ছাড় ও ওয়্যারহাউজ খুলে দেওয়ার আদেশ নিয়ে আসে কেপিপিএল। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে পরবর্তী সময়ে রায় পায় এনবিআর। এসব অভিযোগে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রায় একডজন মামলা করেছে এনবিআর। এর মধ্যে দুটি এখনও চলমান রয়েছে। কাঁচামাল সংকট, উৎপাদন কমে যাওয়া ও মামলার কারণে ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি উৎপাদন বন্ধ করে কেপিপিএল কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন দিন উৎপাদন বন্ধ থাকায় মেশিনপত্র অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বন্ধ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করা আর জেনে-বুঝে বিষপান করা একই কথা। এ বিষয়টা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চিন্তা করা উচিত। তবে কিছু মানুষ গুজব ছড়িয়ে বন্ধ কোম্পানি নিয়ে জুয়া খেলছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।