বন্ধ খুলনা প্রিন্টিংয়ের শেয়ার কারসাজির পর এবার উল্টো পথে!

আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সার্ভিল্যান্সের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক ঘটনায় এই বিভাগের কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। পুঁজিবাজারে কারসাজির ঘটনা থামছে না, বরং নতুন নতুন কৌশলে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ পুঁজিবাজারের এসব অনিয়ম ধরার জন্য থাকা সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষ করে, কিছু ক্ষেত্রে সার্ভিল্যান্স বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা পুঁজিবাজারের স্পর্শকাতর তথ্য আগে থেকেই পেয়ে গোপনে লেনদেন করছেন অথবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দিচ্ছেন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হচ্ছেন, আর কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বিপুল অর্থ লাভ করছে।
এদিকে কিছুদিন আগে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও এখন উল্টো পথে হাটছে কাগজ ও প্রকাশনা খাতের কোম্পানি খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের শেয়ার।
মুলত বিএসইসি’র তদন্ত কমিটি গঠনের পর থামছে শেয়ারের দর। তবে ৭ টাকায় শেয়ার ৩৩ টাকা লেনদেন হওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন হওয়ার নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো শেয়ারটি দর যখন বাড়ে তখন কী বিএসইসি ও ডিএসইর সার্ভিল্যান্স টিমের নজর পড়েনি। ৭ টাকার শেয়ার ৩৩ টাকার বাড়ার পর ঘুম ভাঙছে বিএসইসি’র। এটা হাস্যকর ছাড়া আর কিছু নয়।
সূত্র মতে, বিএসইসি ও ডিএসইতে দুটি সার্ভিল্যান্স (নজরদারি) টিম রয়েছে, যারা কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেনে সার্বক্ষণিক নজরদারি করে। কোনো কোম্পানির শেয়ার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে অথবা কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হলে সবার আগে এই দুই সার্ভিল্যান্স টিম বুঝতে পারে। কারণ কোনো কোম্পানির শেয়ার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সীমায় যখনই পৌঁছায়, তখনই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সিগন্যাল দিয়ে থাকে। সার্ভিল্যান্স টিম সেই সিগন্যালকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। তারা কারসাজিকারকদের সাথে হাত মিলিয়ে এই সিগন্যালকে দেখেও না দেখার ভান করে।
কারসাজি চক্রের স্বার্থহাসিল হওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে টিম দুটি। অথচ যখনই সফটওয়্যার সিগন্যাল দেয়, তখনই যদি কোম্পানিটির ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতো সার্ভিল্যান্স টিম তা হলে ৭ টাকার শেয়ার ৩৩ টাকায় লেনদেন হতো না। ফলে কারসাজি চক্র বিএসইসি ও ডিএসই’র সাথে মিলে নামসর্বস্ব, উৎপাদনে না থাকা এমনকি বন্ধ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করছে। বিনিয়োগকারীদের পেছনে মূলত কারসাজিকারকরা তাদের কারসাজির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে বন্ধ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএসইসির সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থা যদি কার্যকরভাবে কাজ করত, তাহলে নিয়মিত এসব কারসাজি ধরা পড়ত এবং দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই কারসাজির ঘটনা নজরদারি বিভাগের ‘নাকের ডগায়’ ঘটলেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, বরং কখনও কখনও অভিযোগ উঠছে যে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করছেন বা নির্দিষ্ট স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে যোগসাজশ করছেন।
খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (কেপিপিএল) সম্প্রতি পরিদর্শন গিয়ে বন্ধ পায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।
অথচ প্রায় ২ মাসের মাথায় খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের শেয়ারটি ৭ টাকা থেকে শেয়ারটি ৩৩ টাকায় লেনদেন হয়। অভিযোগ রয়েছে শীর্ষ একটি গ্রুপের আর্শিবাদে শেয়ার টি নিয়ে কারসাজি হয়েছে। আর কারসাজির নেপথ্যে একটি সিকিউরিটিজ হাউজের হাত রয়েছে। ফলে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ৭ টাকার শেয়ার ৪৫০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ টাকায়। এ বিষয়টিকে কারসাজি ও অস্বাভাবিক বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ও লেনদেন অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কারণ তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ডিএসইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে ডিএসইর চিফ রেগুলেটরি অফিসার বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে বিএসইসি। চিঠিতে ডিএসইকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমতে শুরু করেছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ২৯ টাকা ৬০ পয়সায়।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও আইসিবির চেয়ারম্যান আবু আহমেদ বলেন, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের শেয়ার নিয়ে কারসাজি এটা পানির মত পরিস্কার দেখা যায়। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের নিয়মিত চিত্রই এটি। আমরা প্রায়ই দেখি বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারদর পাগলা ঘোড়ার মতো বাড়ে। এসবের পেছনে কাজ করে একটি কারসাজি চক্র।
কয়েক মাস নামসর্বস্ব বন্ধ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে খেলাধুলা করে তার দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে তাতে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করেন। যখনই বিনিয়োগকারীরা ফাঁদে পা দিয়ে কোম্পানিটির শেয়ার বেশি দাম দিয়ে কেনেন, তখনই কারসাজিকারকরা সেসব শেয়ার বিনিয়োগকারীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যান। এটি একটি পরিকল্পিত ফাঁদ। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা জেনে বুঝেই এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে ধরা খান। এই স্বভাব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) একটি প্রতিনিধিদল গত ২৭ জানুয়ারি সরেজমিন কোম্পানিটির খুলনার বাগেরহাটে অবস্থিত কারখানা পরিদর্শন করে বন্ধ দেখতে পায়। সেই খবর ডিএসই তাদের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করে। কোম্পানিটির পক্ষ থেকেও জানানো হয় এই শেয়ারদর বাড়ার পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। এসব খবর দেওয়ার পরও দেখা গেছে কোম্পানিটির শেয়ার টানা বাড়ছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ১১ টাকা ২০ পয়সা। এই দরে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ৮১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই দর বাড়তে বাড়তে ১৫ জানুয়ারি দাঁড়ায় ১৮ টাকা ৯০ পয়সা। মাত্র ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৭ টাকা বেড়ে যায় কোম্পানিটির শেয়ার। এরপর তা টানা বাড়তে বাড়তে গত ৪ ফেব্রুয়ারি এসে দাঁড়ায় ৩৩ টাকা ২০ পয়সায়। এ হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২২ টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
তথ্যানুসারে, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ডিএসইতে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের শেয়ারদর ছিল ৭ টাকা ২০ পয়সা। এর পর থেকেই কোম্পানিটির শেয়ারদর টানা বাড়তে থাকে। বন্ধ থাকা এ কোম্পানিটির শেয়ারদর ও লেনদেন বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে ডিএসইর পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এর জবাবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, কোম্পানিটির সাম্প্রতিক শেয়ারদর ও লেনদেন বাড়ার পেছনে কোনো ধরনের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। ডিএসইর কর্মকর্তারা কোম্পানিটির কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে এর কার্যক্রম বন্ধ পেয়েছে।
সর্বশেষ অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, সমাপ্ত ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১১ পয়সা, আগের হিসাব বছরে যা ছিল ২ টাকা ৯৯ পয়সা। আর সর্বশেষ দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৬ পয়সা, আগের হিসাব বছরের একই সময়ে যা ছিল ১ টাকা ৯৬ পয়সা। ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট দায় দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৯৮ পয়সায়। কোম্পানিটির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ মিলিয়ে মোট ঋণ রয়েছে ৫৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ২৩ কোটি ৬১ লাখ ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৩১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
সর্বশেষ ছয় বছর ধরে টানা লোকসানে রয়েছে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড। সর্বশেষ বছরগুলোয় কোম্পানিটির ব্যবসার পরিধিও ছোট হয়েছে। আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ হিসাব বছর থেকে টানা লোকসানে রয়েছে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ সামান্য আয়ের বিপরীতে কোম্পানিটিকে পরিচালন লোকসান গুনতে হয়েছে ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। বিভিন্ন খরচ শেষে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছে ৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
লোকসানের কারণে আলোচ্য হিসাব বছরে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। একইভাবে পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ হিসাব বছরেও শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটি আয় দেখিয়েছে শূন্য। এ সময়ে তাদের পরিচালন লোকসান গুনতে হয়েছে ২ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর বিভিন্ন খরচ শেষে কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছিল ৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খুলনা প্রিন্টিংয়ের অনুমোদিত মূলধন ১০০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ৭৩ কোটি ৪ লাখ টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ৭ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১ দশমিক ১১ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বাকি ৫৯ দশমিক ১৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।