তিন ইস্যুতে আগে স্থানীয় হলে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বের শঙ্কা বিএনপি’র

আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: জাতীয় সংসদ নির্বাচন নাকি স্থানীয় নির্বাচন কোনটি আগে হবে তা ফের আলোচনায়। গত কয়েক মাস ধরেই থেমে থেমে বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা। বিচ্ছিন্নভাবে এতদিন আলোচনা হলেও গত সোমবার জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টার বক্তব্যের পর বিষয়টি আবার ব্যাপক আলোচনায় চলে এসেছে।
এর আগে বিভিন্ন সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটির একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তির বক্তব্য এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর জরিপ প্রতিবেদনও গেছে আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে। অপরদিকে স্থানীয় সরকারের আগে জাতীয় নির্বাচন চায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আর সরকার জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়ে রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফলে কোন নির্বাচন আগে হবে তা জানার আগ্রহে সংশ্লিষ্টদের দিকে তাকিয়ে দেশের জনগণ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে মন্তব্যের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এমনিতে রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনগণের একাংশের মধ্যে আগে থেকেই সন্দেহ-সংশয় রয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আসায় সেই সন্দেহ-সংশয় আরও পরিপুষ্ট হয়েছে।
কেননা এ সরকারের উদ্যোগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে হলে তা জাতীয় নির্বাচনের আগেই করতে হবে। জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেলে তখন আর তাদের হাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের সময় থাকবে না। তখন বিজয়ী দলের কাছে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সন্দেহের আরেকটি বড় কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা। জনমনে এমন একটা ধারণা আছে, প্রকাশ্যে না হলেও ছাত্র-তরুণরা দল গঠনের ক্ষেত্রে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে।
আর জাতীয় নির্বাচনের আগে দল গোছানোর জন্য এদের কিছুটা সময় প্রয়োজন। এসব কারণে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার একটি প্রচেষ্টা থাকলেও থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের দায়িত্বের মধ্যে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি যুক্ত করা যায়, তবে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করা অনেকটা সহজ হয়ে যায় বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এদিকে তিন কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপি। দলটি মনে করে, এমনটা হলে ‘পতিত’ ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টি হবে, জাতীয় নির্বাচন প্রলম্বিত হবে এবং দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হবে। সেক্ষেত্রে অন্তর্র্বতী সরকারের মূল উদ্দেশ্যই ভেস্তে যেতে পারে। সুতরাং সরকারের উচিত, কেবল জাতীয় নির্বাচনকে ফোকাস করা।
কারণ, একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই এই সরকারের প্রধান লক্ষ্য। এর অংশ হিসেবে দ্রুততম সময়ে সরকারকে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। বিএনপি নেতারা মনে করেন, পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের নানামুখী ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই হতে পারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ।
বিভিন্ন মহল থেকে সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে জমা দেওয়া ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’-এর প্রতিবেদনেও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। তা ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য সামনে রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
গত মঙ্গলবার ইউএনডিপিসহ উন্নয়ন সহযোগী ১৮টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, দুটো নির্বাচন একসঙ্গে করা যায় কি না, এতে কেমন সময় লাগতে পারে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন একসঙ্গে করা সম্ভব নয়।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সবকটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ধাপে ধাপে করতে গেলে এক বছর সময় লেগে যায়। পুরোপুরি এভাবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করতে হলে জাতীয় নির্বাচনের সময় পিছিয়ে যাবে। জাতীয় নির্বাচন এখন নির্বাচন কমিশনের অগ্রাধিকার। নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচন নিয়েই এ মুহূর্তে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের, সেটা সেভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত।
এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি শুরু থেকেই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছে। দলটির নেতারা বলছেন, অন্তর্র্বতী সরকারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন করা। তা ছাড়া এ ধরনের সরকারের অধীনে অতীতে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার নজিরও নেই। আর ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এর আরও বেশি যৌক্তিকতা নেই।
কারণ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে সরকারের মূল যে লক্ষ্য, সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন এগুলো দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
বিএনপির আরও শঙ্কা রয়েছে, এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে সেটা ‘পতিত’ আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনেরও একটা মাধ্যম হতে পারে। কেননা, এই নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লোকজন প্রার্থী হলে তৃণমূলে ব্যাপক হাঙ্গামা-সংঘর্ষ হতে পারে, যেটা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তখন পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে যাবে। আর সেই হাঙ্গামা-সংঘর্ষের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়তে পারে। সুতরাং সরকার এ ধরনের নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে তাদের মূল উদ্দেশ্যই ভেস্তে যেতে পারে।
বিএনপি চলতি বছরের শুরুর দিকে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ, এখন পুরো দেশ ও জাতির ফোকাসটা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন না চাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে দলটি তখন বলেছিল, সংকটটা ওই জায়গাতে, দেশে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। মানুষ সেজন্য একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের পথ পাড়ি দিতে চায়। তা ছাড়া স্থানীয় সরকার দেশ চালায় না।
দেশ চালায় জাতীয় সংসদ, আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ। ফলে গণতন্ত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে জাতীয় সংসদ, এটা কার্যকর হলে গণতন্ত্র সচল হয়। বিএনপি তখন এ-ও জানিয়েছিল, স্থানীয় সরকারের তৃণমূল স্তর হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। সেই ইউনিয়ন পরিষদই তো সরকার এখনো বাতিল করেনি। সেটা যদি বাতিল না করে, সেখানে কীভাবে লোকাল গভর্নমেন্ট নির্বাচন হবে? এদিকে গত সোমবার যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে নিজেদের আপত্তির কথা পুনরায় জানায় বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, তারা গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, যেটি সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে স্থানীয় নির্বাচনের কথা মাথায় আনা যাবে না। কারণ, পতিত আওয়ামী লীগ গর্তের ভেতর মাথা লুকিয়ে রেখেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে তারা গর্ত থেকে মাথা বের করবে, আবারও মাথাচাড়া দেবে। তাই আওয়ামী লীগকে সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না চাওয়ার বিষয়টি আমাদের দলীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত। আইনি এবং সাংবিধানিক বিষয়াবলি বিবেচনায় নিয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তা ছাড়া এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব ও প্রধানতম অগ্রাধিকার হচ্ছে, একটি অবাধ-গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা। এর আগে তাদের অন্য কোনো অগ্রাধিকার নেই।
তিনি আরও বলেন, দেশে স্থিতিশীলতা আনয়ন এবং রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার সংস্কার কার্যক্রম করছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেটা হতে হবে। এখন যদি আমরা অগ্রাধিকার ঠিক না করি, দেশে একটি ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। দেশে এই ধরনের সরকারের অধীনে অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নজির নেই বলেও জানান বিএনপির এই নীতিনির্ধারক।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন মানবে না বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে একমত হবো না। আগেও বলেছি এখনও বলছি, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হবে না। তিনি বলেন, সরকার আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।