সরকারকে চাপে রাখতে মিত্রদের পাশে চায় বিএনপি, সমঝোতা হলে আসন ছাড়ার ইঙ্গিত

আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেড় দশকের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। তবে এখনও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বহুল কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা। নির্বাচন নিয়ে অন্তর্র্বতী সরকারের তরফ থেকে সময় ঘোষণা না করা, সংস্কারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব, ফ্যাসিস্টদের বিচার শুরুর বিলম্ব, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও সরকারের সমর্থনে নতুন দল গঠনের আভাসে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়ছে। অন্তর্র্বতী সরকারকে আরও গতিশীল, তাদের ভুল শুধরানো, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলার উন্নতিসহ দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে চায় দলটি।
এ মিশনে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্রদেরও পাশে চাইছে বিএনপি। ফলে ভোটের আগে মিত্র বাড়াতে চায় বিএনপি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় বছরখানেক বাকি থাকলেও ইতোমধ্যে জোট গঠনে নতুন মিত্রের সন্ধানে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে দলটি। এই নিয়ে কাজ শুরু করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি জোটের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। নানা সমীকরণ সামনে রেখে এগোচ্ছেন দলটির নেতারা। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ায় এবং ছাত্রদের নেতৃত্বে নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া চলমান থাকায় এই ইস্যুটি নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা প্রায় ৪২টি দল নিয়ে ‘সমঝোতার’ নেতৃত্বে আছে বিএনপি।
এর বাইরে ইসলামপন্থি ও বামধারার দলগুলোকেও কাছে টানার চেষ্টা করছে দলটি। এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন দল গঠন করতে যাচ্ছে। তাদের শীর্ষ নেতারাও বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। গত সোমবার রাতে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বৈঠক করেছেন। সবারই লক্ষ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অবশ্য বিএনপি জানিয়েছে, তারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে জাতীয় সরকার গঠন করবে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘আমরা চাই জাতি যেন ঐক্যবদ্ধ থাকে। সেটা ডান হোক বা বাম হোক- যাই বলুন না কেন। আমরা গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চাই। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতিকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে। বিগত দিনেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে কোনো জোট ছিল না। আমরা বলেছি, তাদের সঙ্গে নিয়েই আগামী দিনে আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা করব। আমরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এখনো আলোচনা অব্যাহত রাখছি।
২০০১ এবং ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জোটের রাজনীতিই ভোটের ফল নির্ধারণ করেছে। ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেছিল। সেই সময়ে বিএনপি ১৯৩ আসন ও জামায়াত ১৭টি আসন জয়লাভ করেছিল। সেই সময়ে বিএনপি ৪০ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং জামায়াত ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট গঠন করেছিল।
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৬৩টি আসনে জয়লাভ করেছিল। চারদলীয় জোটের বিপরীতে ভোট পাওয়ার হারও ৫৬ শতাংশের বেশি। ফলে এই সময়ে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে সংসদে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছিল দল দুটি।
সারা দেশে যাদের নিজস্ব ভোট ব্যাংক, কর্মী ও সমর্থক রয়েছেন এবং নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধন আছে এমন রাজনৈতিক দলগুলোকেই জোটে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেবে বিএনপি। বিএনপি জোট থেকে বের হয়ে যাওয়া নিবন্ধিত ইসলামী দলসহ কয়েকটি দলের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করছে দলটি। ইতোমধ্যে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে বিএনপি। এ ছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে বিএনপি। দলটির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে একসময়ে ছিল জামায়াত, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। পরবর্তী সময়ে জামায়াত বাদে তিন দলই বিভিন্ন কারণে জোট থেকে বেরিয়ে যায়।
ওই সূত্র জানায়, ইসলামপন্থিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। এ জন্য স্থায়ী কমিটির একজন সিনিয়র সদস্যকে বিশেষভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে নামার আগে প্রতিটি কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠক করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এবারও ঠিক একইভাবে অন্য দলের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে প্রয়োজনে ‘আসন সমঝোতা’ করে হলেও এসব দলকে পাশে চাইছে বিএনপি।
কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এখন বিএনপির দূরত্ব। এই পরিস্থিতিতে দল দুটির মধ্যে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধলে আগামী নির্বাচনে কিছু আসন পাওয়া পেতে পারে। এই কারণে কোনো কোনো দলকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ জোটে দেখা যেতে পারে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমেদ বলেন, বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা হয় এবং সম্পর্ক রয়েছে। তারাও আমাদের ডাকেনি, আমরাও যাইনি। তবে নির্বাচনে জোট হবে কি না তা এখনই বলা যাবে না। তিনি বলেন, আমাদের টার্গেট ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা এবং ভোটে একটি বাক্স নিশ্চিত করা। এ বিষয় ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বিএনপি বা আওয়ামী লীগের জোটে গিয়ে কোনো দলই শক্তিশালী হয়নি, বরং ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। আমরা মনে করি, এখন ইসলামি দলগুলোকে নিজেদের স্বার্থেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠনিক যোগাযোগ রয়েছে। সরকার যেহেতু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাই আমরা আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। সরকার যদি দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দিতে না চায় তাহলে গণতান্ত্রিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, বিএনপিসহ সব দলের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে এবং আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। তবে জোট হবে কি না, নাকি আমরা এককভাবে ভোটে অংশ নেব তা পরিষ্কার হতে আরও কয়েক মাস সময় লাগবে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ হোক। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ-বিভেদ বন্ধ হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের বিচারের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্য হতে হবে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর জোট গড়ার চেষ্টা করছে দেশের ধর্মভিত্তিক প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী।
নির্বাচনে ভোট ‘এক বাক্সে’ আনার চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে জামায়াত ও চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন। তাদের উদ্যোগের সঙ্গে একমত পোষণ করছে বেশির ভাগ ইসলামী দল। সম্প্রতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের বরিশালের বাড়িতেও যান জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। পরে বিএনপি মহাসচিবও পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দলের আমির চরমোনাই পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, যারা যুগপৎ আন্দোলনে ছিল তাদের নিয়ে বিএনপি জাতীয় সরকার গঠন করবে। কিন্তু আমরা বিএনপির সঙ্গে আগেও জোটে ছিলাম না, যুগপৎ আন্দোলনেও ছিলাম না। জাতীয় সরকারে থাকা না থাকা নিয়েও তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। যদি প্রস্তাব পাই তাহলে দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।