জরিমানা নয় দৃশ্যমান শাস্তি চায় বিনিয়োগকারীরা, ফের ৮০ কোটি টাকা জরিমানা

আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বিগত সরকার পতনের পর দেশের আর্থিক খাতের প্রায় সব নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পরিবর্তন এসেছে। এ সময়ে যেসব লুটপাট হয়েছে, তা বন্ধে নেওয়া হয়েছে নানা ধরনের সংস্কারমূলক উদ্যোগ। তারই অংশ হিসেবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্বেও পরিবর্তন এসেছে।
নতুন কমিশন আসার পর বিগত সরকারের আমলে পুঁজিবাজারে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার ফের উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্থাটি বিগত ৭ মাসে কারসাজির অভিযোগে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা জরিমানা করলেও, এখনো আদায় করতে পারেনি এক টাকাও। ফলে কারসাজিতে জরিমানা নয় দৃশ্যমান শাস্তি চায় বিনিয়োগকারীরা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের মারপ্যাঁচ ও দীর্ঘসূত্রতায় এসব জরিমানা আদায় সম্ভব নয়। কারসাজিকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে প্রয়োজনে আইনের পরিবর্তন জরুরি বলে মনে করছেন তারা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে অর্থনীতিবিদ মাসরুর রিয়াজকে নিয়োগ দিতে সিদ্বান্ত নেয়। কিন্তু বিএসইসির কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিদ্রোহের কারণে মাসরুর রিয়াজ যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান বিতর্কিত ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রায় দেড়বছর বেকার থাকা ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজারের কারসাজি চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার উদ্যোগ নেয় কমিশন।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিএসইসির কমিশন সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই সময়ে অন্তত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১২টি কোম্পানির শেয়ার কারসাজি পর্যালোচনা করে বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৯০০ শত টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে কারসাজির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় জরিমানা করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানিকে (বেক্সিমকো)।
বেক্সিমকোর শেয়ার কারসাজি করে ৪৭৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে চার ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠান। কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে এরপর শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিয়েছে তারা। কারসাজির মাধ্যমে ৪৭৭ কোটি টাকা মুনাফা তুলে নেওয়া চার ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ৪২৮ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
এছাড়া ওরিয়ন ফার্মা, ওরিয়ন ইনফিউশনসহ ১১টি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির প্রমাণ মেলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অনিয়ম চিহ্নিত হওয়ায় তাদেরকে রেকর্ড পরিমান জরিমানা করে বিএসইসি। এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তিনটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি—সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস, ফাইন ফুডস ও ফরচুন শুজ লিমিটেডের শেয়ারের দাম কারসাজির অভিযোগে ফেব্রুয়ারিতে ১২ ব্যক্তি ও ৩ প্রতিষ্ঠানকে মোট ৭৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
যাদের জরিমানা করা হয়েছে, তারা হলেন: মো. আবুল খায়ের ১১ কোটি ০১ লাখ টাকা, আবুল কালাম মাতবর ৭ কোটি ২১ লাখ টাকা, কাজী সাদিয়া হাসান ২৫ কোটি ০২ লাখ টাকা, কনিকা আফরোজ ১৯ কোটি ০১ লাখ টাকা, কাজী ফরিদ হাসান ৩৫ লাখ টাকা, কাজী ফুয়াদ হাসান ৩৫ লাখ টাকা, ডিআইটি কো-অপারেটিভ ৫ কোটি টাকা, মোহাম্মদ শামসুল আলম ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ১ লাখ টাকা, সাজিয়া জেসমিন ৪৯ লাখ টাকা, সুলতানা পারভীন ১১ লাখ টাকা, এএএ এগ্রো এন্টারপ্রাইজ ৭৫ লাখ টাকা, আরবিম টেকনো ২৩ লাখ টাকা ও মো. ফরিদ আহমেদ ১ লাখ টাকা।
সোনালী পেপার: সোনালী পেপারের শেয়ার কারসাজির অভিযোগে ৬ জনকে ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। জরিমানাপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন: মো. আবুল খায়ের, আবুল কালাম মাতবর, কাজী সাদিয়া হাসান, কনিকা আফরোজ, কাজী ফরিদ হাসান ও কাজী ফুয়াদ হাসান। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে ২০২১ সালের ২৮ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অধিকতর তদন্ত পরিচালিত হয়। তদন্তকারী দল সোনালী পেপারের শেয়ার লেনদেন সম্পর্কিত বিভিন্ন টিআরইসি হোল্ডার কোম্পানি থেকে সংগৃহীত নথিপত্রকে দৈব চয়নের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, মো. আবুল খায়ের ও তার সহযোগীরা সোনালী পেপারের ৭ লাখ ৩৭ হাজার ৭১টি শেয়ার ক্রয় করেছেন, যা কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১১.২৭ শতাংশ। তদন্তের সময়কালীন সময়ে তাদের ক্যাপিটাল গেইনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২ লাখ টাকা এবং আনরিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ছিল ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে, মো. আবুল খায়ের ও তার সহযোগীরা সোনালী পেপারের শেয়ারের ধারাবাহিক লেনদেনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
ফাইন ফুডস: ফাইন ফুডস লিমিটেডের শেয়ারের দাম কারসাজি ও কৃত্রিমভাবে মূল্য বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ৪ জন বিনিয়োগকারী এবং ২ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মোট ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। মূল কারসাজিকারী হিসেবে চিহ্নিত মোহাম্মদ শামসুল আলমকে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তার ভাই মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে ১ লাখ টাকা এবং তার স্ত্রী সাজিয়া জেসমিনকে ৪৯ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়াও, তাদের বোন সুলতানা পারভীনকে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই চারজন ব্যক্তি একই পরিবারের সদস্য।
মোহাম্মদ শামসুল আলমের সঙ্গে যুক্ত দুটি প্রতিষ্ঠানকেও জরিমানা করা হয়েছে। এএএ অ্যাগ্রো এন্টারপ্রাইজকে ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে, যেখানে তিনি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। অন্যদিকে, আরবিম টেকনোকে ২৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং মোহাম্মদ শামসুল আলম এই প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালক।
বিএসইসি তাদের নজরদারি বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কমিশনের তথ্যমতে, এই সময়ের মধ্যে কারসাজিকারীরা তাদের নেটওয়ার্কের মধ্যে একাধিক লেনদেন পরিচালনা করেছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা সৃষ্টি করেছে যে, পড়তি বাজারেও কোম্পানিটির শেয়ার কার্যক্রম আরও সক্রিয় ও চাহিদা বেশি রয়েছে। তারা একাধিক ব্রোকারেজ ফার্ম ও বেশ কয়েকটি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছে। এছাড়া, তারা এই সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জ বা নিয়ন্ত্রক সংস্থায় ঘোষণা না দিয়েই কোম্পানির ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করেছে, যা আইন এবং নিয়মবিরোধী।
ফরচুন সুজ: ফরচুন শুজের শেয়ার কারসাজির অভিযোগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা চার ব্যক্তি এবং এক প্রতিষ্ঠানকে মোট ৭৭ কোটি ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। জরিমানাপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন: মো. আবুল খায়ের, আবুল কালাম মাতবর, কাজী সাদিয়া হাসান, কনিকা আফরোজ এবং ডিআইটি কো-অপারেটিভ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর থেকে ২৬ অক্টোবরের মধ্যে তদন্ত পরিচালিত হয়।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মো. আবুল খায়ের ও তার সহযোগীরা ফরচুন শুজের ১ কোটি ৭১ লাখ শেয়ার ক্রয় করেছেন। তারা উল্লেখিত বিও অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩৭.৮৪ শতাংশ লেনদেন করেছেন। তদন্তের সময়কালীন সময়ে তারা ৭৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা ক্যাপিটাল গেইন রিয়ালাইজ করেছেন এবং তাদের আনরিয়ালাইজড গেইন ছিল ৪২ কোটি ৩৮ লঅখ টাকা। এই পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে যাতে ভবিষ্যতে শেয়ার বাজারের স্বচ্ছতা এবং সঠিকতার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা যায়।