আলমগীর হোসেন ও শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফু ওয়াং ফুডস কোম্পানিটি মালিকানা বদলের পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি এবং বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাতের কারণে কোম্পানিটি আজ সংকটে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিয়া মামুন বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া মিয়া মামুনের বিরুদ্ধে ডিলারের অর্থ লোপাটের অভিযোগ।

তবে মিনোরিকে পুঁজিবাজারে আলাদিনের চেরাগ হিসেবে ব্যবহার করছেন মিয়া মামুন। মিনোরি বাংলাদেশের মালিকানায় রয়েছেন জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি মিয়া মামুন। তাঁর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে তালিকাভুক্ত এমারেল্ড অয়েল ও ফু-ওয়াং ফুডসসহ একাধিক কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। এমনকি নানা গুজব ছড়িয়ে কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর আকাশচুম্বী করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

২০০০ সালে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ফু ওয়াং ফুডস। পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপনা এবং বোর্ডের অনিয়মের কারণে ২০০০ সালে জানুয়ারিতে জাপানি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মিনোরি বাংলাদেশ লিমিটেড ৭.৬১ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় এবং মিয়া মামুন কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত হন। তবে বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) মিনোরি বাংলাদেশকে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের নির্দেশ দেয়, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।

বর্তমানে মিয়া মামুন নিজে কোম্পানির দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ফু-ওয়াং ফুডসের ১ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এটি ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচটি ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে হয়েছে। আরও জানা যায় যে, নতুন এমডি যোগ দেওয়ার পর তিনি কোম্পানির তহবিল থেকে ২১ লাখ ২০ হাজার ৭৮২ টাকা ব্যয় করেন ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়ার জন্য, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ছিল।

এছাড়া, হলিডে প্ল্যানার নামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০২৩ সালে ৯টি চেকের মাধ্যমে ২১ লাখ ৬৪ হাজার টাকা খরচ করা হয়, যা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদন ছাড়া। এ অভিযোগের পর, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফু ওয়াং ফুডস বর্তমানে উৎপাদন বন্ধ এবং সম্প্রতি তাদের শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশও প্রদান করা হয়নি।

এদিকে ফু-ওয়াং ফুডসের আর্থিক প্রতিবেদনে বিভিন্ন প্রতারণার কথা উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষক। কোম্পানিটির সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষায় এ আপত্তি জানানো হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। নিরীক্ষক জানিয়েছেন, কোম্পানিটির আর্থিক হিসেবে ৫৮.৬৭ কোটি টাকার স্থায়ী সম্পদ দেখানো হয়েছে। তবে ওই সম্পদের রেজিস্টার না থাকায়, সত্যতা যাচাই করা যায়নি। এছাড়া হিসাব মান অনুযায়ী, প্রতি ৩-৫ বছর অন্তর সম্পদ পূর্ণমূল্যায়ন করা দরকার পড়লেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালের পরে আর করেনি।

কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আর্থিক হিসেবে ৯.১৩ কোটি টাকার মজুদ পণ্য দেখিয়েছে। তবে, সরেজমিনে কারখানা পরিদর্শনে অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ৩৪০ আইটেমের মধ্যে ১০৪টি আইটেম কাঁচামাল, বিক্রয়যোগ্য পণ্য ও প্যাকিং জিনিসের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য অগ্রিম ৩.২১ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে বলে আর্থিক হিসাবে উল্লেখ করেছে ফু-ওয়াং ফুডস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে, ২.৮৮ কোটি টাকা পূর্বের বছরের। এ অর্থের বিষয়ে কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট সঠিক জবাব দিতে পারেনি নিরীক্ষককে। এমনকি কাঁচামাল সরবরাহকারীদের তালিকাও নেই। যাতে ওই অগ্রিম অর্থের বিষয়টি অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক।

নিরীক্ষক জানিয়েছেন, কোম্পানির ১০৭.২২ কোটি টাকার ঋণাত্মক সংরক্ষিত মুনাফা (রিটেইন আর্নিংস) রয়েছে। এর মধ্যে, ৯৯ লাখ টাকার লোকসান ইনকাম স্টেটমেন্টের পরিবর্তে রিটেইন আর্নিংসে সমন্বয় করা হয়েছিল। এই লোকসান যদি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইনকাম স্টেটমেন্টে দেখানো হতো, তাহলে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) কমে দাঁড়াত ০.০৯ টাকা। তবে, কোম্পানিটি সেটা না করে ইপিএস বাড়িয়ে দেখিয়েছে।

আর্থিক হিসেবে কাঁচামাল সরবরাহকারীরা ১৭.৮৬ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, নিরীক্ষক এ বিষয়ে সত্যতা যাচাইয়ে পাওনাদারদের চিঠি দিলেও ২৭ জনের মধ্যে ১১ জনের পাওনার বিষয়ে সত্যতা পেয়েছে। আর কোম্পানির হিসেবের সঙ্গে ২.১৯ কোটি টাকার অসঙ্গতি পাওয়া গেছে।

এছাড়া বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফু-ওয়াং ফুডসের উৎপাদন প্রায় বন্ধ। নিয়ম থাকলেও, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দেয়া হয়নি কোন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। বেতন না দেওয়ায় দেখা দিয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ। পরিবেশকদের টাকা লোপাট ও সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ না করার মাধ্যমে দায়-দেনা বাড়িয়ে এখন প্রায় বন্ধের পথে কোম্পানিটি। কেক, বিস্কুট, বান সহ ফু-ওয়াং ফুডসের রয়েছে জনপ্রিয় প্রায় ৫৬টি খাদ্য পণ্য। বাজারে বেশ চাহিদাও রয়েছে এসব পণ্যের।

কোম্পানিটি কোনো কারণ ছাড়াই গত ৯ ফেব্রুয়ারি এক অফিস আদেশে উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেয়। ২৮ মার্চ পর্যন্ত দুই শিফটে উৎপাদন চালুর কথা থাকলেও বাস্তবে বেশিরভাগ সময় তা বন্ধ থাকে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে ডিএসইকে জানানো হয়নি উৎপাদন বন্ধের কারণও। যা তালিকাভুক্তি আইনের পরিপন্থী। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। বেতন বন্ধ রাখা, দক্ষ লোকবল ছাঁটাই করে কারখানা স্থায়ী বন্ধ করার পাঁয়তারা বুঝতে পেরে মার্চে দুই দফা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন শ্রমিক, কর্মচারীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফু-ওয়াং ফুডস এর কারখানার শ্রমিক বলেন, লভ্যাংশের টাকা পাই না। আমভদের প্রোভিডেন্ড ফান্ডের টাকা পাই না। যে টাকা জমাই সে টাকারও খবর নাই। সব আত্মসাত করে বসে রয়েছে মালিক। ২০২৩ সালে কোম্পানির ডিলারদের কাছ থেকে পণ্য বিক্রির ২ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়। যা কোম্পানির মূল ক্যাশ বইয়ে না দেখিয়ে কোম্পানির হিসাব বিভাগে হাতে লেখা রেজিষ্ট্রার এ লিপিবদ্ধ করা হয়। পরিবেশকদের টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে ক্যাশে দেয়ার নির্দেশ দেয় কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। সে বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০ শে আগষ্ট পর্যন্ত ১৫ দফায় মোট এক কোটি ছিয়ানব্বই লক্ষ সতের হাজার সাতশত চুয়াত্তর টাকা কোম্পানি থেকে তুলে নেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিয়া মামুন।

এসব বিষয়ে জানতে ফু ওয়াং টাওয়ারে গেলে সেখানে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। পরিবেশক, ডিলারসহ অন্যান্য পাওনাদারদের ভয়ে প্রধান ফটকে তালা দিয়ে অফিস করছেন কর্মকর্তারা। মিয়া মামুনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে জানানো হয়, তিনি অফিসে অনুপস্থিত। কথা বলেন হোয়াটসঅ্যাপে। তার দাবি, নগদ লেনদেনে তেমন ক্ষতি হয় না কোম্পানির। উৎপাদন বন্ধের বিষয়েও দেন নানা যুক্তি।

ফু-ওয়াং ফুডস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিয়া মামুন বলেন, স্বচ্ছতা-অস্বচ্ছতা বাদ দিলাম, আমার কথা হচ্ছে আমি নিয়ম ভাঙছি কিনা? আমি বিকাশে টাকা নিলে বা ক্যাশ টাকা নিলে কি নিয়ম ভাঙছে? প্রমাণও নাই আমি এই টাকা নষ্ট করে ফেলেছি। আমি যদি মাল কমায়-বাড়ায় সবকিছুর কি পিএসআই দিতে হবে?
ফু-ওয়াং ফুডসের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদের অব্যাহত দুর্নীতি, অর্থ-আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতির কারনে বন্ধ হতে বসেছে কোম্পানিটি। সাধারণ শেয়ারহোল্ডার, শ্রমিক-কর্মচারী, ক্ষতিগ্রস্ত সরবরাহকারীদের সুরক্ষায় ডিএসই ও বিএসইসিকে বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান তাদের।