আস্থা ও তারল্য সংকট এবং জরিমানা ইস্যুতে বিপর্যস্ত পুঁজিবাজার

শহীদুল ইসলাম ও মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের পুঁজিবাজারে কোনোভাবেই আস্থা ফিরছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সেসব উদ্যোগের কোনোটিতেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না। দিন দিন এ আস্থা আরও তলানিতে ঠেকছে। এতে যেমন বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে ব্রোকারেজ হাউসগুলোও লেনদেন খরার ফলে বিপাকে পড়েছে। ফলে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব গোষ্ঠীর মনেই এখন এক চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কবে ফিরবে পুঁজিবাজারে সুদিন, সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তারা।
তাছাড়া পুঁজিবাজারে লেনদেন খরা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় বাজার মূলধনও কমছে সমানতালে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে সব খাতে সংস্কারের মতো বিএসইসিতেও সংস্কার করে। বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা পদত্যাগ করলে দায়িত্বে আসেন নতুন কমিশন। তবে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার সাত মাসেও পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে পারেনি। বরং একের পর এক জরিমানা করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।
ডিবিএ এক শীর্ষ নেতা বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) জরিমানা ছাড়া কোন উন্নতি নাই। সত্যিকার অর্থে বিএসইসিতে কোন কাজ হচ্ছে না। কাজ বিএসইসির, কিন্তু বিএসইসি তাদের কাজ মন্ত্রণালয়ে দিয়ে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে ৫০ বছর পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই বিএসইসিতে গত ৮ মাসে কোন আইপিও পেন্ডিং নাই। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা নাই। এই বাজারে পণ্য সরবরাহ খুবই বাজে।
এদিকে দেশের শিল্পায়নে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জোগান দেয় পুঁজিবাজার। কিন্তু বর্তমানে এখানে মূল সমস্যা আস্থার সংকট।
গত কয়েক বছরে নানা কারণেই এই আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে শিবলী রুবাইয়াত কমিশনের আমলে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা সংকট বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে চরম সংকটময় পরিস্থিতি কাটিয়ে নতুন বছরের চার মাস অতিক্রম করলেও এখনো আস্থা ফিরেনি পুঁজিবাজারে। বিশেষ করে রাশেদ মাকসুদ কমিশনের আমলে জরিমানা হিড়িকে আতঙ্কে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। কারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে আতঙ্ক না কাটলে বাজার স্থিতিশীল করা কঠিন। এ অবস্থায় বর্তমান পরিস্থিতিতে আস্থা ফিরিয়ে পুঁজিবাজার গতিশীল করা বিএসইসি’র জন্য বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
কারণ কয়েক বছর ধরে চলমান বৈশ্বিক অনৈতিক মন্দা, ব্যাংক খাতে অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, অর্থ পাচার ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি পুঁজিবাজার। ফলে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়তে হয়েছে বিনিয়োগকারীদের। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আশা-নিরাশার দোলাচলে শুরু হচ্ছে নতুন বছর ২০২৫। এ বছর স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে পুঁজিবাজারে গতিশীল করাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে ঈদের আগে শেষ তিন কার্যদিবস পুঁজিবাজারে সূচকের উর্দ্বমুখী প্রবনতা দেখা মিললেও ঈদের পর ফের দরপতনের মধ্যে দিয়ে লেনদেন চলছে। ঈদের পর গত সপ্তাহে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসেই দাম কমার তালিকায় ছিল বেশি সংখ্যক কোম্পানি। এতে গত সপ্তাহজুড়ে লেনদেনে অংশ নেওয়া বেশি সংখ্যক কোম্পানি শেয়ার ও ইউনিটের স্থান হয়েছে দাম কমার তালিকায়। ফলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বাজার মূলধন ২ হাজার কোটি টাকার ওপরে কমেছে। তবে বেড়েছে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। আর বিদায়ী সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৬ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকায়। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইতে বাজার মূলধন ২ হাজার ২২৩ কোটি টাকা কমেছে।
সপ্তাহটিতে টাকার পরিমাণে লেনদেন ৮০৯ কোটি ২৬ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৩৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকায়। আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৬২৭ কোটি ১১ লাখ টাকা।
সপ্তাহটিতে ডিএসইর প্রধান সূচক ১৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২০৫ পয়েন্টে। অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ৪ পয়েন্ট এবং ডিএসই-৩০ সূচক ১৩ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ১৭২ পয়েন্টে এবং ১ হাজার ৯২৭ পয়েন্টে। সপ্তাহটিতে ডিএসইতে ৩৯৫ টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১৪১ টির, দর কমেছে ২৩৫ টির এবং ১৯টির শেয়ার দর অপরিবর্তিত রয়েছে।
অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) বিদায়ী সপ্তাহে সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৩১.৯৭ পয়েন্ট বা ০.২১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৫০৯.৩৭ পয়েন্টে। সিএসইর অপর সূচক সিএসসিএক্স ৮.৭৯ পয়েন্ট বা ০.০৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৩৪.১৭ পয়েন্টে।
অপর ২টি সূচকের মধ্যে সিএসই ৫০ সূচক ৪.৫৩ পয়েন্ট বা ০.৪১ শতাংশ কমে এবং সিএসআই সূচক ৭.২৭ পয়েন্ট বা ০.৭৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে- এক হাজার ১০৮.৮৮ পয়েন্টে এবং ৯৪৯.৪৪ পয়েন্টে।