গরমে বাড়ছে আইসক্রিমের বিক্রির ধুম, বাড়বে কোম্পানিগুলোর মুনাফা

আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: কড়া রোদ, তার ওপর ভ্যাপসা গরম। দুইয়ে মিলে ত্রায়ী অবস্থা। ঘর থেকে বের হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘামে ভিজে যায় কাপড়। এ অবস্থায় সামান্য স্বস্তি খোঁজতে মরিয়া রাজধানীবাসী। অনেকেই তীব্র গরম থেকে বাঁচতে বেচে নেন ঠান্ডা কোমল পানীয়। আবার অনেকের ভরসা আইসক্রিম। তাই প্রত্যেক বছর মার্চের শুরু থেকে বেড়ে যায় আইসক্রিমের চাহিদা। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে বড়-বড় সুপার শপ ও শপিং মলে আইসক্রিম বিক্রির ধুম পড়েছে। রাজধানীর কাঁঠালবাগান, নিউ মার্কেট, বসুন্ধরা শপিং মলসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
বিক্রেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শীত থাকায় এ সময়ে আইসক্রিম বিক্রিতে ভাটা চলছিল। তবে এখন সেই চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিদিনই বাড়ছে আইসক্রিমের চাহিদা। রাজধানীর গ্রিন রোডে তাজওয়া ফার্মায় ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি বিক্রি করা হয় ঠান্ডা পানীয়। দোকানটিতে ওষুধের পাশাপাশি আইসক্রিমও বিক্রি হয় সমান তালে। দোকানের ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ জানান, সপ্তাহখানেক থেকে তার দোকানে আইসক্রিম বিক্রি ভালো হচ্ছে। গরমের কারণে আইসক্রিমের চাহিদা বেড়েছে।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইসক্রিমের ব্যবসার বড় অংশই গ্রীষ্মকালকেন্দ্রিক। গরম যত বেশি, আইসক্রিমের ব্যবসাও তত ভালো। এ কারণে দেশে বছর বছর গরমের তীব্রতা যত বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে আইসক্রিমের বাজারও। খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত এক দশকে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে আইসক্রিমের বাজার।
যদিও দেশে আইসক্রিমের বাজার ও সেই বাজারে কার কত হিস্যা, এ নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে এ খাতের একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে দেশের আইসক্রিমের বাজারের আকার আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। এই বছর যা বেড়ে তিন হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর এই খাতে প্রবৃদ্ধি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। প্রতিবছর আইসক্রিমের যে ব্যবসা হয়, তার ৮০ শতাংশ হয় মার্চ থেকে আগস্ট এই ছয় মাসে। দেশের আইসক্রিমের বাজারের দুই তৃতীয়াংশ দখলে রয়েছে আব্দুল মোনেম গ্রুপের ইগলু ও ঢাকা আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিজের পোলার ব্র্যান্ডের। এ ছাড়া সেভয়, লাভেলো, জা এন জি, ব্লুপ, কোয়ালিটি, বেলিসিমোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই বাজারে।
আইসক্রিম তৈরির কাঁচামালের মধ্যে চিনি, বাটার ও পানি দেশেই পাওয়া যায়। এর বাইরে চকলেট, মিল্ক ফ্যাট, ফুল ক্রিম দুধ, ফ্লেবারসহ অন্যান্য উপাদান আমদানি হয় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামালে ৩৫ থেকে ১০০ শতাংশ করভার রয়েছে। ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্রে এই করভারকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা মনে করেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ছাড়া সংরক্ষণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতাও এই ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় বাধা।
বর্তমানে প্রতিদিন দেড় লাখ লিটারের বেশি আইসক্রিম উৎপাদন করছে ইগলু ব্র্যান্ড। প্রতিষ্ঠানটির আইসক্রিম, ডেইরি ও ফুড ইউনিটের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক নাসিরুজ্জামান বলেন, মূলত মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত আইসক্রিমের ব্যবসা তুঙ্গে থাকে। আইসক্রিম তৈরির বিভিন্ন উপাদান যেমন চকলেট, মিল্ক ফ্যাট, ফুল ক্রিম দুধ ও ফ্লেবারের মতো কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক এ খাতের ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও অপ্রতুল। এসব কারণে এ খাতের ব্যবসা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইসক্রিমসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন হারভেস্টের ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে দেশে আইসক্রিমের বাজারের আকার ছিল ৭৩০ কোটি টাকার। ২০২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বাজারে আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ চার বছরে আইসক্রিমের ব্যবসা বেড়েছে ৩ গুণের বেশি।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইস-ক্রিম পিএলসি গত ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে সমাপ্ত দ্বিতীয় প্রান্তিকের (অক্টোবর’২৪-ডিসেম্বর’২৪) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুয়ারী কোম্পানিটির মুনাফায় বড় চমক দেখিয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৬১ পয়সা। গত বছর একই সময়ে আয় হয়েছিল ২৫ পয়সা। হিসাববছরের প্রথম দুই প্রান্তিক মিলিয়ে তথা ৬ মাসে (জুলাই’২৪-ডিসেম্বর’২৪) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ১ টাকা ৫২ পয়সা। গত বছর একই সময়ে আয় ছিল ৫৭ পয়সা।
সম্প্রতি তাওফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম পিএলসির ব্র্যান্ড লাভলো আইসক্রিম দ্বিতীয় আইসক্রিম উৎপাদন কারখানা স্থাপনের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। কোম্পানিটির পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে এই সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য লাভেলো ময়মনসিংহের ভালুকায় বিদ্যমান উৎপাদন কারখানাসংলগ্ন ৫৯.১৬ শতাংশ জমি কিনেছে। নতুন আইসক্রিম উৎপাদন ইউনিটের মূলধনী যন্ত্রপাতি কেনার জন্যে কোম্পানিটি আন্তর্জাতিক সরবরাহকারী টেট্রা পাক সাউথইস্ট এশিয়া (সিঙ্গাপুর), এমইসি গ্রুপ (চীন), টেকনোআইস (ইতালি) ও ইয়ানতাই মুন কো. লিমিটেডের (চীন) সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করবে।
কোম্পানি সেক্রেটারি মো. মহিউদ্দিন সরদার বলেন, এই সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমরা আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি করার পরিকল্পনা করছি। পাশাপাশি বাজার হিস্যা বাড়ানোর লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে একটি বৃহৎ মার্কেট সেগমেন্টের কাছে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করছি। উৎপাদন শুরু হওয়ার পর লাভেলোর নতুন কারখানা দৈনিক ২ লাখ ৫০ হাজার লিটার আইসক্রিম উৎপাদন করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা লাভেলোর বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জুনে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বাজারে ব্র্যান্ডের আইসক্রিমের মধ্যে পোলার শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। তারা বাজারে ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ আইসক্রিম সরবরাহ করে। দ্বিতীয় অবস্থানে ইগলু। তাদের বাজার হিস্যা প্রায় ২৭ শতাংশ। এ ছাড়া ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বাজার হিস্যা নিয়ে সেভয় রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। লাভেলোর বাজার হিস্যা ১১ দশমিক ৭২ শতাংশ, তালিকায় তারা চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া বেলিসিমো, জা-এন-জি, ব্লুপ, কোয়ালিটি ও চট্টগ্রামের পান্ডা, মাগুরার পিপাসা, খুলনার মিল্কিসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের আইসক্রিম রয়েছে বাজারে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আইসক্রিম পারলার। যেখানে আইসক্রিমের পাশাপাশি কফি, জুসসহ নানা ধরনের পানীয় বিক্রি হয়। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইসক্রিম প্রতিষ্ঠান মুভেনপিকের ধানমন্ডি শাখার ব্যবস্থাপক মুরাদ রাজ প্রথম আলোকে বলেন, মূলত গরমে আইসক্রিম বিক্রি বাড়ে। তবে ধানমন্ডিতে শীত কিংবা অন্যান্য সময়েও আইসক্রিমের ভালো চাহিদা থাকে। আগে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকার আইসক্রিম বিক্রি হলেও গত কয়েক দিনের তীব্র গরমে এই বিক্রি দৈনিক গড়ে এক লাখ টাকা ছাড়িয়েছে।
বেলিসিমো আইসক্রিম পারলারের ধানমন্ডি শাখার ব্যবস্থাপক বুলবুল আহমেদ বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর বিক্রি ৩০ শতাংশের বেশি। প্রতিদিন এখন দুই শতাধিক ক্রেতা আসেন। আগে প্রতিদিন গড়ে এক শর কাছাকাছি ক্রেতা ছিল। ধানমন্ডির শেফস টেবিল ফুডকোর্টে রয়েছে সেভয় গ্যালারি নামের আইসক্রিমের পারলার। তাদের কাছে রয়েছে মোট ১৪টি ফ্লেবারের আইসক্রিম। সেভয় গ্যালারির ধানমন্ডি শাখার ব্যবস্থাপক সুমন হোসেন বলেন, আগে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ টাব (৫ লিটারের আইসক্রিমের বক্স) আইসক্রিম বিক্রি হলেও এখন ১৮ থেকে ২০ টাব বিক্রি হচ্ছে।
গত কয়েক দিনের তীব্র গরমে রাজধানীর পাড়া মহল্লার দোকানগুলোতেও আইসক্রিম বিক্রি বেড়েছে। মোহাম্মদপুরে কথা হয় মুদিদোকানি শিমুল বড়ুয়ার সঙ্গে। ইগলু ও পোলারের নানা ধরনের স্টিক ও ১ লিটারের টাব আইসক্রিম পাওয়া যায় তাঁর দোকানে। তিনি বলেন, গরমে বিক্রি কিছুটা বাড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, অন্য সময় প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার আইসক্রিম বিক্রি হলেও এখন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার আইসক্রিম বিক্রি হয়।
গত এক দশকে ভারতের আইসক্রিম বাজার বড় হয়েছে দেশে। ভারতীয় আইসক্রিম প্রস্তুতকারক সংস্থা (আইআইসিএমএ) জানিয়েছে, আইসক্রিমের বাজারের বর্তমান প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী তিন বছরের মধ্যে এই বাজারের আকার বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি রুপিতে। খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের আইসক্রিমের ৫০ শতাংশ ক্রেতাই শিশু থেকে ৩০ বছরের তরুণ–তরুণীরা। তবে মধ্য বয়সী ক্রেতার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
লাভেলো আইসক্রিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একরামুল হক বলেন, দেশে পাঁচ বছর আগেও ঢাকার বাইরে এত বড় বাজার ছিল না। তবে গত কয়েক বছরে আইসক্রিম বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো মেট্রোপলিটন শহরের বাইরে ব্যবসা সম্প্রসারণে মনোযোগী হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে কোন ও কাপে প্যাকেটজাত আইসক্রিম। বেসরকারি একটি আইসক্রিম প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা ও তার চারপাশের অঞ্চলে ইগলু ও পোলারের রেফ্রিজারেটরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তার পরেই রয়েছে সেভয়, লাভেলো ও বেলিসিমোর মতো প্রতিষ্ঠান।