শহীদুল ইসলাম ও মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রোজার ঈদের আগে বাজার কিছুটা ভাল থাকলেও ঈদের পর থেকে পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের মুখে পড়েছে। ফলে টানা পাঁচ কার্যদিবস সূচকের পতনে অজানা আতঙ্ক বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের মনে। এর ফলে দেশের পুঁজিবাজারে মন্দাবস্থা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমছে। তাদের লোকসান বাড়তে বাড়তে নিঃস্ব হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পতন ঠেকাতে বিএসইসি’র কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। সংস্কার ও জরিমানার নামে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। যার কারণে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই।

এছাড়া তারল্য সংকট এবং নতুন বিনিয়োগের অভাবে বাজারে থাকা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অজানা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে উল্টো শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। নতুনদের আকৃষ্ট করতে না পারা এবং বাজারে সক্রিয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার অভাবে সংকট আরও গভীর হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে অংশীজনের অংশগ্রহণ কমছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাজারে সুফলভোগীরাও নতুন বিনিয়োগ থেকে সরে এসেছে। উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের শেয়ার আরও লোভনীয় দামে কিনে নিতে পতনকে ত্বরান্বিত করতে চাচ্ছে। তবে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বিতর্কিত করতে কারসাজি চক্রের সদস্যরাও পরিকল্পিতভাবে পুঁজিবাজারের পতন ঘটাচ্ছে বলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটি সূত্র দাবি করেছে।

এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জে সুশাসনের অভাব দেশের পুঁজিবাজারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বড় কারণ ছিল। কিন্তু মৌলিক এ জায়গার কাঠামোগত সংস্কারের কোনো উদ্যোগ এখনও নেই। উল্টো বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে খোদ কমিশনের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় পুঁজিবাজার স্বাভাবিক ধারায় চলা তো দূরের কথা, উল্টো দর পতন হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই সব শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছাড়ছেন।

গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত আট মাসে পরিবর্তনের আশায় প্রায় ২১ হাজার বিনিয়োগকারী নতুন করে বিও অ্যাকাউন্ট খোলেন। কিন্তু একই সময়ে প্রায় ৪৮ হাজার বিও অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি শেয়ার শূন্য হয়েছে। সরকার বদলের পর দীর্ঘ সময়েও দেশের পুঁজিবাজার সংস্কারে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি না থাকায় হতাশা বাড়ছে।

একাধিক বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, কিছু ব্রোকারেজ হাউজ ও তালিকাভুক্ত কোম্পানির জালিয়াতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে আস্থার সংকট আরও গভীর হয়েছে। মশিউর সিকিউরিটিজের ১৬১ কোটি টাকার আত্মসাতের ঘটনা সর্বশেষ ধাক্কা হিসেবে কাজ করেছে। এর আগে ক্রেস্ট ও বানকো সিকিউরিটিজ কেলেঙ্কারির এখনও পূর্ণাঙ্গ সমাধান পায়নি। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় দৃশ্যমান পদক্ষেপের দাবি জানাচ্ছেন তারা।

অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও শক্ত মনিটরিং ব্যবস্থার বিকল্প নেই। তা না হলে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে পড়বে, যার পরিণতিতে আরও গভীর সংকটে পড়তে পারে দেশের পুঁজিবাজার।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদনমুখী তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে বছর শেষে মুনাফা কমে আসবে। সে ধারণা থেকেই লেনদেনের পুরো সময়টিতে উৎপাদনমুখী কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমতে দেখা গেছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, পুঁজিবাজারে সুশাসনের অভাবই বড় সমস্যা। সুশাসন না থাকার মূলে ছিল গত কয়েকটি কমিশন। তারা যথেচ্ছভাবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থবিরোধী আইন করেছে। নিজেদের স্বার্থে মন্দ কোম্পানির আইপিও এনেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না এবং নিজেরা জড়াবেন না এমন পরিবর্তন মানুষ প্রত্যাশা করে। সে লক্ষ্যে এখনও কোনো সংস্কারের দেখা নেই।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন সূচকের সাথে কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর ও টাকার পরিমানে লেনদেন। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দিনশেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ২২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৭৪ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৮ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ১৩৫ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৮৭২ পয়েন্টে।

দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৯৬ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১০১ টির, দর কমেছে ২৪৩ টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৫২ টির। ডিএসইতে ৩৫১ কোটি ৮ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের কার্যদিবস থেকে ১১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা কম। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৩৩৯ কোটি ২৯ লাখ টাকার ।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৬১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১৯৭ পয়েন্টে। সিএসইতে ২১৪ টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬২ টির দর বেড়েছে, কমেছে ১৩১ টির এবং ২১ টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।