শহীদুল ইসলাম ও মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: টানা দরপতনে ন্যুব্জ দেশের পুঁজিবাজার। ফলে দিন যতই যাচ্ছে পুঁজিবাজারের হাহাকার ততই বাড়ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ মানেই লোকসান। যার ফলে পুঁজিবাজারে নজিরবিহীন অস্থিরতা বিরাজ করছে। ‘অদ্ভুত’ এমন পুঁজিবাজার ৩০ বছরের ইতিহাসে দেখিনি যায়নি বলে বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ বেড়েছে। তাছাড়া রাশেদ মাকসুদ কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার ৮ মাস অতিবাহিত হলেও এখন আস্থা ফেরাতে পারেনি পুঁজিবাজার। বরং আস্থা বিনিয়োগকারীদের যেটুকু ছিল তাও সংকটে পড়েছে। ফলে দিন দিন বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে।

এদিকে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচক ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে অবস্থান করেছে। এটি বর্তমান চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদ কমিশনের আমলে সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে গেছে এবং বাজারে ক্রেতার অভাব দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ার বড় বিনিয়োগকারীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেল প্রেসার দিয়ে নিচে নামিয়ে ফেলছেন বলে বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেছেন।

এদিকে গত ১৮ আগস্ট চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন রাশেদ মাকসুদ। দায়িত্ব গ্রহনের পর বিনিয়োগকারীদের আশার আলো দেখালেও বাস্তবে গত ৮ মাসে বিনিয়োগকারীরা নি:স্ব হয়েছেন। এখন বিনিয়োগকারীদের একটাই আর্তনাদ আমাদের বাঁচান, আমাদের পুঁজি শেষ। আর দৈনিক লেনদেনের ধীর গতিতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না বিনিয়োগকারীরা।

তেমনি বিএসইসি চেয়ারম্যানের নেওয়া বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে বিনিয়োগকারীদের মনে তৈরি করেছে আস্থার সংকট। এছাড়া বিএসইসি এখন পর্যন্ত এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি যে সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে। অন্যদিকে কোন বিনিয়োগকারী বেশি পরিমাণ শেয়ার কিনলেই বিএসইসি থেকে ফোন দিয়ে কারণ জানতে চাওয়া হয়।

এদিকে পুঁজিবাজারে অংশীজন থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারী পর্যন্ত সবাই বলছেন, কেউ ভালো নেই। কারণ শেয়ারের অব্যাহত দরপতনে সবাই বড় অঙ্কের পুঁজি হারিয়েছেন। সরকার বদলের পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নেতৃত্বের বদল হলেও বাজারে কোনো আশার আলো দেখা যায়নি। বিদ্যমান সংকটেরও সমাধান হচ্ছে না। যে কারণে দরপতনের একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে পুঁজিবাজার। এতে হতাশা বাড়ছে সর্বমহলে। আগে বিএসইসির একটি অংশ দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন বিএসইসি পরিণত হয়েছে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে। সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাজারমুখী নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া অতীতে নানা ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় বিএসইসির কর্মকর্তাদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনকে চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে। একদিকে ঘর সামাল দেওয়া, অন্যদিকে বাজারের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ দুইয়ের সমন্বয় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে কমিশনকে। তাই কাজের গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসা ছেড়ে দিয়েছেন। যাদের শেয়ার আছে সেই বিনিয়োগকারীরা জানতে চান, এ বাজার আদৌ ‘ভালো’ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা কোনো উত্তর পাচ্ছেন না।

অন্যদিকে পুঁজিবাজারে গত ৮ মাসের দরপতনে বড় ক্ষতির মুখে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর কার্যত অভিভাবকহীন ছিল বিএসইসি। এসময়ে ঊর্ধ্বমুখী ছিল পুঁজিবাজার। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৮০০ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে গিয়েছিল। লেনদেনও বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছিল।

কিন্তু গত বছরের ১৯ আগস্ট খন্দকার রাশেদ মাকসুদ যোগদানের পর থেকে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৭৭৫ পয়েন্ট থেকে ৮০৩ পয়েন্ট কমে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত তা দাঁড়িয়েছে ৪৯৭২ পয়েন্টে। লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা থেকে নেমে আসে তিনশত কোটিতে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেন, পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক দিন ধরে পুঁজিবাজারে টানা পতন হচ্ছে। সূচক ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে। ফলে পুঁজিবাজার নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা বাড়ছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের বড় পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন সূচকের সাথে কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। তবে টাকার পরিমানে লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দিনশেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ৪৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৯৭২ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ১০৪ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ২২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৮৪৫ পয়েন্টে।

দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৯৮ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৫২ টির, দর কমেছে ৩০০ টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৬ টির। ডিএসইতে ৩৬৭ কোটি ১৪ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের কার্যদিবস থেকে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বেশি। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৩০০ কোটি ৬১ লাখ টাকার ।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৫৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৯৫৬ পয়েন্টে। সিএসইতে ২১৮ টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫০ টির দর বেড়েছে, কমেছে ১৪১ টির এবং ২৭ টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে ৭ কোটি ১৩ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।