শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে রক্তক্ষরণ চলছে। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তারল্য সংকট বেড়েছে, নতুন বিনিয়োগ আসছে না। ডিএসই’র অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম নেমে গেছে তলানিতে, যার ফলে মূল্যসূচক ও বাজার মূলধনে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। কারসাজি ও অনিয়মের বৃত্ত ভেঙে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না পুঁজিবাজার। মুনাফার আশায় এসে উল্টো পুঁজি হারিয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্য সব খাতের মতো পরিবর্তন আসে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শীর্ষ পদে। দুজন নতুন কমিশনার এবং একজন পুরোনোকে সঙ্গী করে কমিশনের দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। ফলে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের আস্থা ছিল নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি নতুন করে গতি ফিরবে পুঁজিবাজারে। সব পক্ষের ভরসার পাত্র হয়েই তিনি কঠিন সময়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন।

দায়িত্ব নেওয়ার আট মাস পার হলেও পুঁজিবাজারের গতি বাড়ার বদলে উল্টো আরও কমেছে। দৈনিক লেনদেন, বাজার মূলধন কমাসহ বিনিয়োগকারী এবং ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মধ্যে হতাশা চরম আকার ধারণ করেছে। এছাড়া পুঁজিবাজারে গত ৮ মাসের দরপতনে বড় ক্ষতির মুখে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর কার্যত অভিভাবকহীন ছিল বিএসইসি। এসময়ে ঊর্ধ্বমুখী ছিল পুঁজিবাজার।

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৮০০ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে গিয়েছিল। লেনদেনও বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছিল। কিন্তু গত বছরের ১৯ আগস্ট খন্দকার রাশেদ মাকসুদ যোগদানের পর থেকে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৭৭৫ পয়েন্ট থেকে ৮৩৯ পয়েন্ট কমে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত তা দাঁড়িয়েছে ৪৯৩৬ পয়েন্টে। লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা থেকে নেমে আসে তিনশত কোটিতে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও সুশাসনের অভাবের কারণে আস্থার সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিনিয়োগকারীরা লোকসানের মুখে পড়ে শেয়ার বিক্রি করছেন, যার ফলে বাজার আরও দুর্বল হচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ না আসায় বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া পুরনো বিনিয়োগকারীদের হতাশা ছড়াচ্ছে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের কাছেও। ফলে বিনিয়োগে সক্ষম মানুষ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে সরকারি সঞ্চয়পত্র কিনে বা ব্যাংকে আমানত রেখে যতটা ‘রিটার্ন’ পাচ্ছেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকছেন।

একটি শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাজারে ছোট, মাঝারি ও বড় সব ধরনের বিনিয়োগকারীই এখন হতাশ। নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইছেন না, বরং অনেকে লোকসান মেনে নিয়ে বাজার ছেড়ে দিচ্ছেন। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ছে। গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিনিয়োগকারীরা নতুন আশার আলো দেখেছিলেন, কিন্তু সেই আশা বাস্তবে রূপ নেয়নি। পরিবর্তিত সরকারও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর চার দিনে ডিএসইর প্রধান সূচক ৭৮৬ পয়েন্ট বাড়লেও, তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরবর্তী ৮ মাসে বাজার ঘুরেফিরে আগের অবস্থানেই ফিরে এসেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বিএসইসির বর্তমান কমিশন দক্ষতা ও সক্ষমতার দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা আনতে তাদের কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে বিনিয়োগকারীরা বিএসইসির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মতিঝিলে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন। যদিও বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির কোনো প্রমাণ নেই, তবে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্বল নীতিমালার কারণে বাজারে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। টাকার পরিমানে লেনদেন কমে তলানিতে নেমেছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, দিনশেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ১৭ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪ হাজার ৯৩৫ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯৩ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৮২৪ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৯৭ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৩৬ টির, দর কমেছে ২১১ টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৫০ টির। ডিএসইতে ২৯১ কোটি ৭ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের কার্যদিবস থেকে ১৬২ কোটি ৭২ লাখ টাকা কম। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৪৫৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকার ।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৩০ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮১৫ পয়েন্টে। সিএসইতে ২০০ টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭১ টির দর বেড়েছে, কমেছে ৯৭ টির এবং ৩২ টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে ১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।