খেলাপি ঋণের শীর্ষে জনতা ব্যাংক দ্বিতীয় অবস্থানে ইসলামী ব্যাংক

আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন ভয়াবহ সঙ্কটে। খেলাপি ঋণের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার, তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ঋণগ্রহণের অপসংস্কৃতি এবং দুর্বল তদারকি একে অনিরাপদ করে তুলেছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ যেন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এককভাবে কিছু গ্রাহকগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অনৈতিক প্রভাব, ব্যাংক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং ‘ঋণ নাও, ফেরত দিও না’ সংস্কৃতি পুরো ব্যাংক খাতকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ১৩ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে দশ ব্যাংকেই রয়েছে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারের সময়ে অনিয়ম-জালিয়াতির শীর্ষে থাকা ব্যাংকগুলোই রয়েছে এ তালিকায়। সরকার ঘনিষ্ঠরা বিভিন্ন ব্যাংকে একক আধিপত্য বিস্তর করে নামে-বেনামে বিভিন্ন উপায়ে আমানতকারীর টাকা আত্মসাৎ করেন; যার একটি বড় অংশ পাচার করা হয়। ফলে এসব ঋণ আর ফেরত আসছে না। গত ৫ আগস্টের আগে টাকা ফেরত না দিয়েও ঋণ নিয়মিত দেখানোর যে ব্যবস্থা ছিল তাও বন্ধ হয়েছে। এসব কারণে লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
পরিমাণ বিবেচনায় খেলাপি ঋণে এখন শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির ৯৪ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৭০ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা এখন খেলাপি। মোট ঋণের যা ৭৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ব্যাংকটিতে বেক্সিমকো গ্রুপের প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা এবং এস আলমের ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
এছাড়া ক্রিসেন্ট লেদার, অ্যানটেক্স, বিসমিল্লাহসহ বিভিন্ন জালিয়াতি ঘটেছে এই ব্যাংকে। ঋণের ৭৫ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়ায় ভীষণ দুরবস্থায় পড়েছে জনতা ব্যাংক। মুলত ব্যাংক খাতের আরও শঙ্কার বিষয় হচ্ছে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি এখন ভাল ব্যাংকগুলোরও খেলাপি ঋণ লাফিয়ে বাড়ছে।
বিশেষ করে এদেশে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হল শরীয়াহ ভিত্তিক পরিচালিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। অন্য যেকোনো ব্যাংকের তুলনায় ইসলামী ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাস বেশি। ঋণ বিতরণ, আমানত সংগ্রহ, ঋণ আদায় ও প্রবাসী আয় সংগ্রহে ব্যাংকটি এখনো শীর্ষে রয়েছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ব্যাংকটিতে ঘটেছে ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মের ঘটনা। ঋণের নামে ব্যাংকটি থেকে লুট করা হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
এসব টাকার অধিকাংশই পাচার করা হয়েছে বিদেশে। এসব লুটের টাকা ফেরত না আসায় এক সময়ের শক্তিশালী ব্যাংকটি এখন খেলাপিতে জর্জড়িত হয়ে পড়েছে। এমনকি খেলাপি ঋণের দিক থেকে ইসলামী ব্যাংক দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে রয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুয়ায়ী ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া উচ্চ খেলাপির পাশাপাশি বাড়ছে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ইসলামী ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৯৪০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ৪৭ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এসব খেলাপি ঋণের মধ্যে অতি মন্দ বা আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে ২২ হাজার ৪৬০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
আর গত বছরের অর্থাৎ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ০৮ শতাংশ। সেই হিসাবে তিন মাসে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ৮০১ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ইসলামী ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৫২৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৯১৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা। যেটা ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত লোনের ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা।
এরও আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ইসলামী ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮০১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। বিতরণকৃত এসব ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছিল ৫ হাজার ৪০২ কোটি ২০ লাখ টাকা। যেটা ছিল ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সেই হিসাবে দুই বছরের ব্যবধানে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ২৭ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক সময়ের শক্তিশালী ব্যাংকটি এখন মন্দ ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রভিশনও রাখতে পারছে না। নিয়ম অনুযায়ী মন্দ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশন রাখার কথা ছিল ২৩ হাজার ৬৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি রাখতে সক্ষম হয়েছে ৭ হাজার ১৯৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সেই হিসাবে মার্চ শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এক সময় ব্যাংকটির ভাল ভাবমূর্তি ছিল। এগুলো অতীতের ঘটনা। ব্যাংকটির করপোরেট গভর্নেন্স ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও অভিযোগ উঠেছে। সেটারই একটা উপসর্গ হল ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়া। তাদের তো তারল্য সংকটও আছে। জালিয়াতির মাধ্যমে যে ঋণটা চলে যায় সেটা আর ফিরে আসে না। এছাড়া, জালিয়াতি ছাড়াও তাদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ছিল। ঋণ দেয়ার সময় তারা কি খতিয়ে দেখেছে যে তাদের ঋণ ফেরত আসবে কি না?
তাদের মতে, ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রভাব অন্য ব্যাংকের উপরও পড়তে পারে। অবস্থা যখন খারাপ হয় তখন সবার অবস্থাই খারাপ হয়। এজন্যই তো ঋণের সুদের হার বেশি হয়। কারণ, লস যেটা হয় সেটাতো তারা পুষিয়ে নিবে।