স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সেবা ও আবাসন খাতের কোম্পানি সাইফ পাওয়ারটেকের দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) থেকে বিদায়ের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। প্রায় দুই দশক ধরে টার্মিনালটি অপারেশন করছিল প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগ রয়েছে, এতদিন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে মনোপলি ব্যবসা করেছে তারা।

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় থেকে টার্মিনালটিতে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে। কিন্তু বিদেশি অপারেটর নিয়োগে নানামুখী বিতর্ক তৈরি হওয়ায় সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একটু ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছে সরকার।

এরই মধ্যে আগামী ৭ জুলাই বর্তমান অপারেটর সাইফ পাওয়ার টেকের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তাই আপাতত বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে টার্মিনালটি পরিচালনার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৮ জুলাই থেকে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি।

এদিকে সাইফ পাওয়ারটেকের সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়ার ঘোষণা করেছিল। সেই হিসাবে একজন বিনিয়োগকারী প্রতি শেয়ারের বিপরীতে মাত্র ১০ পয়সা লভ্যাংশ পাবে। কোম্পানিটি সেই লভ্যাংশ গত পাঁচ মাসেও বিনিয়োগকারীদের দিতে পারেনি। অথচ কোম্পানির রির্জাভে ১৬৮ কোটি টাকা আছে, যা নিয়ে বিনিয়োগাকারীদের বিরূপ মনোভাব দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০০৬ সালে বন্দরে গ্যান্ট্রি ক্রেন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে সাইফ পাওয়ারটেকের কাজের হাতেখড়ি হয়।

বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনালের ১২টি জেটির মাধ্যমে কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়। এরমধ্যে সাইফ পাওয়ার টেকের হাতে সবচেয়ে বড় ও সরঞ্জামসমৃদ্ধ টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) চারটি জেটি এবং চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালের (সিসিটি) দুটি জেটির নিয়ন্ত্রণ। সাইফ পাওয়ারটেকের হাতে যে ছয়টি জেটি রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমেই বন্দরের ৬৫ শতাংশ কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়। অথচ বিনিয়োগকারীদের সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ঘোষিত লভ্যাংশ সময়মতো দিতে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি।

সাইফ পাওয়ারটেক অর্থবছরে (২০২৩-২৪) কোম্পানিটির সমন্বিত শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৭০ পয়সা। আলোচিত সমাপ্ত হিসাব অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ হয়েছে এক টাকা ৮৮ পয়সা। গত ৩০ জুন কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৭ টাকা এক পয়সা। ঘোষিত ১ শতাংশ লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেয় গত ৩০ ডিসেম্বর বার্ষিক সাধারণ সভায়। এরপর দুুই মাস পেরিয়ে গেলও বিনিয়োগকারীদের মাত্র ১০ পয়সা লভ্যাংশ দিতে পারেনি। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি।

বন্দর সূত্র জানায়, এনসিটি অপারেশনের জন্য দুবাইভিত্তিক টার্মিনাল অপারেটর প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে কাজ শুরু করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর শর্ত কিছুটা হালনাগাদ করে এনসিটিতে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। পতিত সরকারের আমলে আন্দোলনের সাহস না পেলেও বর্তমান সরকারের উদার নীতিতে জেঁকে বসে সব পক্ষ। বন্দরে বিদেশি অপারেটর আসতে দেওয়া হবে না বলে একযোগে আন্দোলনে নামে বন্দরের শ্রমিক কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠনগুলো।

তবে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে, এসব আন্দোলনের পেছনে বর্তমান অপারেটর প্রতিষ্ঠানের উসকানি রয়েছে। নানামুখী বিতর্কে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়ার গতি একটু কমিয়ে দিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে আগামী ৭ জুলাই সাইফের সঙ্গে বন্দরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তাই পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে গত বুধবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যাতে মন্ত্রণালয় ও বন্দর কর্তৃপক্ষের নীতিনির্ধারকরা উপস্থিত ছিলেন।

ওই বৈঠকেই উপস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, সাইফ পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ না বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর থেকেই জোরেশোরে এনসিটি পরিচালনার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বহুল আলোচিত এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বন্দর পরিচালনায় নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বড় ধরনের কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রাম বন্দরের পরিকল্পনা ও প্রশাসন বিভাগের সাবেক সদস্য জাফর আলম জানান, ২০০৭ সালের আগে টার্মিনাল অপারেশনের দায়িত্ব বন্দরের হাতেই ছিল। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়। কথায় কথায় ধর্মঘটসহ নানান রাজনৈতিক প্রভাবও বন্দরের ওপর ছিল। স্বল্প সময়ের জন্য হলে ঠিক আছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই প্রক্রিয়া চলবে না। এক্ষেত্রে বড় ধরনের কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বন্দরকে। যন্ত্রাংশ অপারেশন হয়তো মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট করবে কিন্তু শ্রমিক জোগান দেওয়া সবচেয়ে বড় সংকটের তৈরি করবে।

নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বন্দর পরিচালনায় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বার্থ শিপ হ্যান্ডলিং ও টার্মিনাল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে ইকরাম চৌধুরী। তার মতে, বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দিলেও তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেওয়া হবে। সময় শেষে টার্মিনালটিকে বন্দরের হাতে হস্তান্তর করার কথা। তখন বন্দরকেই টার্মিনালটি পরিচালনা করতে হবে। তাই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন একটি একটা অভিজ্ঞতা বন্দর কর্তৃপক্ষ অর্জন করবে বলে মনে করছেন তিনি।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ জানান, বন্দর কে চালালো, ব্যবহারকারীদের কাছে সেটা গুরুত্বপুর্ণ নয়। বন্দর ব্যবহারকারীরা দেখবে কত দ্রুত তারা সেবা পাচ্ছে। সাইফ পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তির মেয়ার বাড়ছে না সেটা আরো কয়েক মাস আগেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাই বন্দর কর্তৃপক্ষ হয়তো তার মতো করে একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত কি না তা সময় বলে দেবে।

মাহফুজুল হক শাহ বলেন, বন্দরের মতো বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানে আমলাতান্ত্রিক কিছু জটিলতা থাকে। তাই যে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে যায় । কিন্তু টার্মিনাল অপারেশনের ক্ষেত্রে কিছু সিদ্ধান্ত জরুরি ভিত্তিতে নিতে হয়। না হলে সেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পরে। এ দিকগুলো বন্দর কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার অ্যান্ড মেরিন) ক্যাপ্টেন আহমেদ আমিন আবদুল্লাহ জানান, মন্ত্রণালয় থেকে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। তবে এনসিটি পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সবকটি ডিপার্টমেন্ট আলাদাভাবে কাজ শুরু করেছে। দু-একদিনের মধ্যেই চূড়ান্ত রূপরেখা নির্ধারণ করা হবে। দীর্ঘদিন টার্মিনালটি এক নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। এখন অন্য নিয়মে পরিচালিত হতে গেলে কিছুটা চ্যালেঞ্জ আসবে। কিন্তু এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার দক্ষতা ও প্রস্তুতি দুটোই বন্দরের আছে।

এদিকে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদনকৃত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ৩৭৯ কোটি টাকা। যার মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার মালিকানা আছে ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগাকরীদের ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগাকারীদের হাতে মালিকানা রয়েছে ৪২ দশমিক ৪৮ শতাংশ।