শেয়ারের দর বাড়লেই ডিএসই নোটিশ, কমলে চুপ!
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দর অস্বাভাবিক হারে বাড়লে এর কারণ জানতে চেয়ে নোটিশ জারি হলেও টানা দরপতনের কারণ জানতে চায় না বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা অথবা স্টক এক্সচেঞ্জ। ফলে শেয়ারের দর বাড়ার কারণ জানতে পারলেও দর কমার কারণ কখনও জানতে পারেন না বিনিয়োগকারীরা।
যে কারণে দরপতনে নীরব দর্শক হয়ে থাকা ছাড়া কোন উপায় থাকে না তাদের সামনে। এ পরিস্থিতির অবসান চান বিনিয়োগকারীরা। দর বাড়ার পাশাপাশি কমার কারণ জানতে চান তারা।
তবে ২০১০ সালে ধসের পর দীর্ঘদিন পুঁজিবাজারে মন্দাভাব বিরাজ করে। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব ফিরতে শুরু করেছে। বাজারে নতুন পুরাতন বিনিয়োগকারীদের বিচরণ বাড়ছে। বাড়ছে লেনদেন ও শেয়ারদর। বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে, বাড়ছে পুঁজিবাজারের পরিধি। বাজারের এই চাঙ্গা অবস্থার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনেক দুর্বল লোকসানি কোম্পানির শেয়ারদর।
বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন কোম্পানির শেয়ার বিক্রেতাশুন্য হয়ে পড়ছে। কোন কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিক বাড়লে স্টক এক্সচেঞ্জগুলো বিশেষ করে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচঞ্জ (ডিএসই) গধবাঁধা নিয়মে কোম্পানিগুলোর কাছে জানতে চায়-শেয়ারটির দর বাড়ার কোন কারণ আছে কী-না। কোম্পানিগুলোও গধবাঁধা নিয়মে জানিয়ে দেয়-শেয়ারটির দর বাড়ার কোন কারণ নেই বা দর বাড়ার কারণ তাদের জানা নেই।
ডিএসইর তথ্যানুসারে, সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মুন্নু সিরামিকস, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস, ইমাম বাটন, দুলামিয়া কটন, ঝিলবাংলা, শ্যামপুর সুগার, রহিমা ফুড, মেঘনা পেট, মেঘনা কনডেন্সমিল্ক, প্রভাতী ইন্সুরেন্স, রুপালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সহ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার দর কয়েক কার্যদিবস ধরে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেখা যায়।
ফলে কারণ জানতে চেয়ে নোটিস দিয়েছে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ। উত্তরে দর বাড়ার পেছনে কোন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দর বছরের পর বছর ধরে কমলেও ডিএসইর পক্ষ থেকে দর কমার কারণ অনুসন্ধান করে না।
কিংবা পতন রোধেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয় না। ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা জানান দর বাড়ার পাশাপাশি দর কেন কমছে তা জানার অধিকার তাদের রয়েছে। তাই এ বিষয়ে নিয়ম হওয়া জরুরী বলে মনে করেন তারা।
যে কোন শেয়ারের দর অস্বাভাবিক হারে বাড়লেই কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কাছে এর কারণ জানতে চায় স্টক এক্সচেঞ্জগুলো। যা সত্যিই প্রসংশনীয়। কেননা কোন কোম্পানির শেয়ার দর কারণ ছাড়া অস্বাভাবিক হারে বাড়লে সেখানে কারসাজির সম্ভাবনা থাকে।
এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ঝুঁকি বহুলাংশে বেড়ে যায়। তাই বাজারের নীতি-নির্ধারক হিসেবে এর কারণ খতিয়ে দেখা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নৈতিক দায়িত্ব্য।
কিন্তু একটি কোম্পানির শেয়ার দর বাড়লেই যে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা কিন্তু নয়। কারণ ছাড়া কোন কোম্পানির শেয়ার দর কমলেও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবে এক্ষেত্রে বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকে তেমন কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
অথচ সেখানেও কারসাজির সম্ভাবনা থাকে। কারণ একটি গোষ্ঠি সিন্ডিকেট করে একটি কোম্পানির বৃহৎ অংশের শেয়ার নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে নেয়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ওই শেয়ারকে ঘিরে চাহিদার সৃষ্টি হয়। কিন্তু চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ভারসাম্য না থাকায় সেখানে সব শ্রেনীর বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়তে থাকে। তখনই ওই শেয়ারের দাম হু-হু করে বাড়তে থাকে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোন কোম্পানির ধারাবাহিক দর বৃদ্ধির নেপথ্যে যেমন কারণ প্রয়োজন ঠিক তেমনই অব্যাহত দর পতনের পিছনেও কারণ প্রয়োজন। তাই, দর বাড়লে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ যেমন সক্রিয় হয়ে পড়ে কমলেও একই ভূমিকা থাকা উচিত।
কিন্তু প্রশ্ন সেটি নয়, প্রশ্ন হলো একটি কোম্পানির দর ৫ কার্যদিবসে ৭০% বাড়লো, অথবা একটি কোম্পানির দর একমাস ধরে শুধু বাড়লো আর বাড়লো, এমনকি দর বেড়ে ঝুঁকিপূর্ন অবস্থানে গেলো। কিন্তু কোনো নোটিশ নেই। আর আরেকটি কোম্পানির দর তিনদিন বাড়লো, তাও ১০ থোকে ২০ শতাংশ, অমনি নোটিশ। এই বৈষম্য কেনো? কার স্বার্থে? এমন প্রশ্ন এখন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।
তাদের অভিযোগ, কোনো কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে দর সামান্য বাড়লেই নোটিশ পাঠাতে ডিএসইর চুলকানি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু দিনের পর দিন যখন একটি কোম্পানির দর পড়তে থাকে, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দর কমা নিয়ে আতঙ্ক শুরু হয়ে যায়, তখন ওই নোটিশওয়ালাদের চুলকানি বন্ধ থাকে, তারা তখন সুখ নিদ্রায় বিভোর থাকেন। এটিও আরেকটি বৈষম্য।
একাধিক বিনিয়োগকারীরা বলছেন, শেয়ারের দর বাড়লে ডিএসই কোম্পানিগুলোকে শোকজ করে। এটা ঠিক আছে। কিন্তু যখন শেয়ারের দর বাড়ে তখন শোকজ করে না কেন? দর বাড়লে নোটিশ দেয়াটা যদি তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তাহলে দর কমলে, কেন দর কমছে তার কারণ জানাটা দায়িত্বের মধ্যে পড়বে না কেন? তাদের মতে, বিনিয়োগকারীদের জন্য দর বাড়ার কারণ জানা যেমন জরুরী, তেমনি দর কমলে তার কারণ জানাটাও জরুরী।
তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, দর বাড়ার ক্ষেত্রে শুধু একটা নোটিশ জারি করার মধ্যে ডিএসইর দায়িত্ব শেষ করাটা উচিত নয়। দর বাড়ানোর পেছনে কাদের হাত রয়েছে, শেয়ারটির কারসাজি হচ্ছে কীনা-এটি দেখাও ডিএসইর দায়িত্ব।
তাদের মতে, ডিএসইকে ট্রেডিশনাল ভূমিকা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং কার্যকর ও সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। ডিএসই যদি শেয়ার কারসাজিকারীদের সনাক্ত করতে আন্তরিক হয়, তাহলে তাদের কাছে এটি কোন ব্যাপারই নয়। কারণ শেয়ার লেনদেনের যাবতীয় রেকর্ড তাদের কাছে রয়েছে। কারা শেয়ারটি কিনছে, কারা শেয়ারটি কিনছে, কোন হাউজ থেকে কেনাবেচা হচ্ছে-সবই ডিএসইর জানা।
এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা হারানো পুঁজি উদ্ধার করতে গিয়ে আবার যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকে। আর পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতার বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে যেকোন কারসাজিক সংশ্লিষ্ট সকলকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। তা না হলে পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ার প্রকৃত কারণকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কারণ এর মধ্যে বিনিয়োগকারীদের লাভ-লোকসানের বিষয় যুক্ত। কোনো শেয়ারের দাম কারণ ছাড়া বাড়লে তা এক সময় অবশ্যই পড়বে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাই এটা নিয়ে আমাদের ভাবনাও বেশি। কিন্তু শেয়ারের দাম কমলে তা এক সময় অবশ্যই বাড়বে। এটা নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তিত নই। মূলত শেয়ারের দর বাড়া-কমা একটি আরেকটির পরিপূরক।’
ডিএসই ব্রোকারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ)-এর সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়ার কারণ ডিএসই বিনিয়োগকারীদের জানাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নোটিশ পাঠায়।
কী কারণে শেয়ারের দাম বাড়ছে তা বিনিয়োগকারীদের জানা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানির অনেক তথ্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পান না। কিন্তু কিছু লোক তা পেয়ে মুনাফা লুটে নেয়। ডিএসই জানতে চাইলেও প্রতিষ্ঠানগুলো গতানুগতিক উত্তর দেয় যে, দাম বাড়ায় মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই। আবার দুই বা তিন মাস পর ঠিকই কোনো না কোনো তথ্য বের হচ্ছে। এতে কিছু লোক ফায়দা লুটে নেয়। আর ক্ষতির সম্মুখীন হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
দুঃখের বিষয়, এমনটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অন্য দেশে এমনটা হয় না। কোম্পানিগুলোর উচিত সব তথ্য সবাইকে জানানো। তাহলে সেসব তথ্যের এর ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করতে পারেন সব বিনিয়োগকারী।