আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুরোপুরি নির্বাচনমুখি আওয়ামী লীগ। দেশি ও বিদেশি চাপ এবং নিষেধাজ্ঞাতেও দলটি বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন থেকে সরে যাবে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিদ্যমান সংবিধানই আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে যেতে সাহস ও ভিত্তির যোগান দিচ্ছে। যত চাপ বিশেষ করে ভিসানীতি প্রয়োগের ভয় দেখান হোক না কেন, বাংলাদেশের সংবিধানে হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার বিদেশিদের নেই। আর বিএনপির এক দফা আন্দোলন সফলতার মুখ দেখবে না বলে ধরেই নিয়েছে দলটি। পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার পর সমর্থন পেয়েছে ভারতের।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক দেশি-বিদেশি শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ সামাল দিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি বছর জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক এবং কিছু বিষয় নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা কয়েকগুণ বেড়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের অনেকের সরকার বিরোধী অবস্থান যেন আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। অনেক ঘটনায় প্রকাশ্যে সোচ্চার হয়েছেন তারা। তাদের জোরাল সরকার বিরোধী অবস্থান যেন বিএনপির জন্য আশীর্বাদ ও সহায়ক শক্তি হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে।

বিবৃতি ও ভিসানীতি প্রয়োগের মাধ্যমে চাপ সৃর্ষ্টির বিপরীতে সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে নিজ অবস্থানে অনড় রয়েছে আওয়ামী লীগ। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে ভয় পাওয়া কিংবা ঘাবড়ানোর কিছু নেই, এতে বিরোধী দলের কথাও বলা আছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আওয়ামী লীগেরও চাওয়া। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি বাংলাদেশের বাইরে থেকে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করে, সে ক্ষেত্রে এই দেশের জনগণ ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেবে।

এছাড়া আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে বেগ পেতে হবে না আওয়ামী লীগকে। পশ্চিমা দেশগুলো একের পর এক সরকার বিরোধী বিবৃতি দিয়ে আসছিল, যা অনেকটা বিএনপির পক্ষে ছিল। সম্প্রতি পশ্চিমা দেশগুলো সেই অবস্থান থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে রয়েছে বলে দাবি দলটির নীতিনির্ধারকদের।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির আন্দোলনের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন তৎপরতায় অনেকটা ভাটা পড়েছে। একই সঙ্গে গত জি-২০ সম্মেলনের পর দৃশ্যপট আরও বদলে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সফরের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা এখন অনেকটাই নির্বাচন নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। এ ছাড়া রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং এর পরপরই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সরকারের প্রতি তাদের বিশেষ সমর্থন ফুটে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মহলের তৎপরতায় মনে হচ্ছিল সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে।

কারণ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা ধারাবাহিকভাবে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। প্রতিটি বৈঠকের পর তারা ব্রিফিংয়ের বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতেও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে।

দেশটি বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা দেবে তারা এই ভিসানীতির আওতায় আসবে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছিল বিদেশিরা। কিন্তু সেটি এখন আর নেই। গত ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২২ সেপ্টেম্বর ওই অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন তিনি। এ ভাষণের মধ্য দিয়ে বিশ্বনেতাদের মনোযোগ কেড়েছেন শেখ হাসিনা।

দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতারা মনে করেন, সম্প্রতি দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের মনোযোগ কেড়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৮ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে নয়া দিল্লি গিয়েছিলেন। সেদিনই বিকালে মোদির বাসভবনে তার সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকের আগে তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।

এ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী সৌদি আরবের যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান আল সৌদ, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো অ্যাঞ্জেল ফার্নান্দেজ, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। এতে বাংলাদেশ, ব্রিটেন, মিসর, মরিশাস, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, স্পেন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত অংশ নেয়। তখন বিশ্বনেতাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শেখ হাসিনা।

সেখানেও বিশ্বনেতাদের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। জি-২০ সম্মেলনের সদস্যভুক্ত দেশ না হয়েও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মূলত বিশ্বনেতাদের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন। একপর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার নিজের মোবাইল ফোনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে সেলফি তোলেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

সম্মেলনের ফাঁকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যেভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, গুরুত্ব দিয়েছেন, দীর্ঘক্ষণ হাত ধরে রেখে কথা বলেছেন, তা কেবল মায়ের কাছে ছেলের আবদারের কথা মনে করিয়ে দেয়। পরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশে আসেন। তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে বলেও এ সফরে জানান ম্যাক্রোঁ।

আওয়ামী লীগের তৃণমূলের একাধিক নেতা বলেন, দেশি-বিদেশি সব পক্ষের তৎপরতায় গত দুই নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ বেশ প্রতিকূল অবস্থায় ছিল। কূটনৈতিক তৎপরতার প্রতিফলন বিএনপির আন্দোলনেও দেখা যাচ্ছিল। তারা রাজধানীসহ সারা দেশের একের পর এক সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি দিয়ে আসছিল।

এতে দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত এক ধরনের শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তবে সেই শঙ্কা এখন আর নেই। একই সঙ্গে গত ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দফতরে নেত্রী বাংলায় দেওয়া ভাষণে বিশ্বনেতাদের আবারও মন জয় করেছেন বলে বিশ্বাস দলের নেতাকর্মীদের।

অর্থাৎ এখন আর আওয়ামী লীগের পেছন ফেরার সুযোগ নেই। কারণ শেখ হাসিনা শুধু একজন দক্ষ রাজনীতিবিদই নন, তিনি একজন দক্ষ কূটনীতিকও। গত ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে সেটাই ফুটে উঠেছে। তার দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস শুধু আওয়ামী লীগেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বনেতাদের মধ্যেও।

আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও বিদেশি চাপ অনেকটাই কেটে গেছে। জি-২০ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সেটি আমরা অতিক্রম করতে পেরেছি। বাংলাদেশ সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও বিশে^র শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি বিশ্বনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন।

সুদক্ষ নেতৃত্ব, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং কর্মকুশলতার উজ্জ্বল প্রভায় বিশ্বনেতাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এবার জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন তিনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেত্রীর এসব উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ডে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ বলেন, গত জি-২০ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর ফলপ্রসূ হয়েছে। নেত্রী তার দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে তা অর্জন করেছেন। গত ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে ভাষণের মধ্য দিয়ে নির্বাচনি বার্তা চলে আসছে। বিএনপি জনগণের চোখে ধুলা দিতে যে ধরনের ষড়যন্ত্র করছে, তা লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। বাইরের দেশের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য দেখে অনেকেরই সহ্য হচ্ছে না। বিএনপির উচিত আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।

বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বরিশাল আওয়ামী লীগ প্রস্তুত। এতদিন বিএনপির আন্দোলন ও বিদেশিদের বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা সবকিছু মøান হয়ে গেছে। গত জি-২০ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের যেভাবে মনোযোগ কেড়েছেন, এরপর বিএনপি চুপসে গেছে। যদিও তারা এখনও সরকার পতনের এক দফা দাবি নিয়ে মাঠে আছে। তাদের দাবি, দাবিই থাকবে কোনো দিন আলোর মুখ দেখবে না।

যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ কোনো ভয় পায় না। কারণ দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শুধু বাংলাদেশের নেত্রী নন, তিনি বিশ্বনেত্রীও। তার অনন্য নেতৃত্বের ফলে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী।

ব্যাকফুটে বিএনপির আন্দোলন: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছন, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে চলমান যুগপৎ আন্দোলন করে যাচ্ছে বিএনপি। বর্তমানে তাদের টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি চলছে। কিন্তু এক দফা দাবি বাস্তবায়নে দাঁড়াতে পারছে না মাঠে। হচ্ছে না নির্বাচনী প্রস্তুতি। নির্বাচনকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তে বিভক্ত হয়ে পড়ছেন দলটির প্রথম সারির নেতারা। রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ নেই খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার।

এবার যুগপৎ আন্দোলনকে অক্টোবরের মধ্যেই চূড়ান্ত ধাপে নিতে কৌশল ঠিক করছে দলটি। মাঠের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারকে কতটা টলানো যাবে, সেই সন্দেহও রয়েছে বিএনপির ভেতরে। কারণ, ঢাকায় বড় জমায়েতের মহাসমাবেশ করার পরদিনই গত ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের জমায়েত সেভাবে ছিল না।

দলটির নগণ্যসংখ্যক নেতাকর্মী সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশের মারমুখী অবস্থানের মুখে মাঠে থাকতে পারেননি। সেই পরিস্থিতি ছিল তাদের জন্য একটা বড় ধাক্কা। একধরনের হতাশাও তৈরি হয়েছিল এবং একটা ছন্দপতন হয়েছিল এক দফার আন্দোলনে। পাশাপাশি মামলায় আটকে যাচ্ছেন বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নিজে থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে চায় না। একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ যতটা সম্ভব সংযত আচরণ করার কৌশল নিয়েছে। কারণ, বিএনপি এখন পর্যন্ত যেসব কর্মসূচি নিয়েছে, এর কোনোটাই সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলার মতো নয়।

এ ছাড়া এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি আন্দোলন করে সরকার ফেলে দেবে এমন আশঙ্কা খুব একটা দেখছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা মনে করেন, বড়জোর বিএনপি সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারবে। আর সেটা রাজনৈতিকভাবে এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ভালোভাবে মোকাবিলা করার সামর্থ্যও আছে।

চীন, রাশিয়া ও ভারতের সমর্থন: বাংলাদেশ ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে এ বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, চীন ও রাশিয়া অনেক আগেই আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়ে রেখেছে। যেকোনো সময় পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে তারা। তাদের পর ভারতের আন্তরিক সমর্থন আওয়ামী লীগ সরকারকে শক্তি যুগিয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ভারতের নিরাপত্তার জন্য বারবার বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

এমন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদীদের প্রশয় না দেয়ার বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখিয়ে আসছে বর্তমান সরকার। এর বাইরে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাদের বিরুদ্ধে সীমান্ত সন্ত্রাসবাদীদের প্রশয় দিয়ে ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের। বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক পরম্পরা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার’ প্রতি ভারত বহু বছর ধরে যে জোরাল সমর্থন দিয়ে আসছে তা আগামী দিনেও পুরোপুরি অব্যাহত থাকবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

বইছে নির্বাচনী হাওয়া: আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র চার মাস বাকি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সাংঘর্ষিক অবস্থানে উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। এমন পরিস্থিতিতেও দেশে বইছে নির্বাচনী ডামাডোল। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নির্বাচনী জনসংযোগে মুখরিত মাঠ-প্রান্তর। বিভিন্ন দিবস ও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ব্যানার ও পোস্টারে ছেয়ে যাচ্ছে এলাকাসমূহ। পথসভা এবং মোটরসাইকেল বহর দিয়ে চলছে শোডাউন। আর বিএনপির নির্বাচনী জনসংযোগ চলছে ভিন্ন কৌশলে। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দলটির সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হাইকমান্ডের সামনে নিজেদের তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, বসে নেই আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে অনেক আগেই নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজ নিজ এলাকায় দলীয় মনোনয়ন পেতে দলীয় হাইকমান্ডের নজরে পড়তে নানা উপায়ে শোডাউন করে যাচ্ছেন দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় জেলা ও বিভাগীয় নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় সভা করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড।

উন্নয়নের নতুন উচ্চতায় দেশ: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার টানা ১৫ বছর পার করতে চলেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। এ সময়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে মনে করছেন বিভিন্ন সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আজকের বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর আদলে বদলে যাওয়া একটি দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, তৃণমূলের জন্য গৃহীত উদ্যোগ এবং নিজে থেকে কিছু করার জন্য মানুষের অদম্য বাসনা উন্নয়ন আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উন্নয়নের ‘রোলমডেল’ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রশংসিত হয়েছে দেশ।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিকবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মালবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। তলাবিহীন ঝুড়ির খেতাব পাওয়া ছোট্ট বদ্বীপটি আজ বিশ্বের ৪২তম অর্থনীতির দেশ।

অর্থনীতির আকার ৩০০ বিলিয়ন ডলার। প্রতিযোগী এবং পার্শ্ববর্তী অনেক দেশকে পেছনে ফেলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এখন ৮.১৫ শতাংশ। আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে। দেশ আজ খাদ্যশস্য-উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। মাথাপিছু আয় ৫৪৩ ডলার থেকে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৫.২ শতাংশ। মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ: সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সাংবাদিকদের বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ আসলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ, যার বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০৯ সালে। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দেশের সব মানুষের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশ, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ডিজিটাল অর্থনীতি ও ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ে তোলার ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।

ডিজিটাল সেন্টার সাধারণ মানুষের জীবনমান সহজ করার পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে দিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের সুফল দেশের প্রত্যেক মানুষ পাচ্ছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থানসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে না।