কক্সবাজারে চলতি মৌসুমে পর্যটন ব্যবসা বেশ রমরমা
মোঃ সিরাজুল মনির, কক্সবাজার থেকে ফিরে, দেশ প্রতিক্ষণ: পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। বেশিভাগ পর্যটকরাই আগে থেকেই হোটেলে রুম বুক না করেই চলে আসে। যার কারণে এ ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। আগে থেকে যদি রুম বুক করে আসতো বা যারা রুম পায়নি তারা যদি না আসতো, কিংবা পরে আসতো তাহলেই আর এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না। বিশেষ করে বন্ধের দিন শুক্রবার ও শনিবার টানা ছুটিতে হোটেল-মোটেল কিংবা রিসোর্টে জায়গা না পেয়ে সৈকত, মসজিদ, রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন পর্যটকরা।
পর্যটন শিল্পের সংশ্লিষ্টদের মতে, ছুটির দিনে ভ্রমণ না করে ভ্রমণের জন্য ছুটি নেয়া উচিত। তা না হলে চরম হতাশাজনক, ভোগান্তির মধ্যে পড়তে পারেন। হোটেল বুকিং নিশ্চিত করে না এলে গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে অটোওয়ালা বা দালাল চক্রের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে আজে-বাজে হোটেলে নিয়ে গিয়ে ফাঁদে ফেলছে।
সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীদলীয় ডাকা হরতাল, অবরোধ ও কয়েকটি নেতিবাচক ঘটনারও প্রভাব পড়েছিল কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে। ভরা মৌসুমেও ছিল না আশানুরূপ পর্যটক। কিন্তু ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের পর রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি না থাকায় পাল্টেছে সেই চিত্র।
সপ্তাহিক ও সরকারি ছুটিতে পর্যটকে ভরপুর কক্সবাজার। হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউসগুলো শতভাগ বুকড। এতে বিগত সময়ের লোকসান পুষিয়ে নিতে পারবে বলে মনে করছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভ্রমণপিয়াসুকরা জীবন থেকে কিছুটা প্রশান্তির আশায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই আসছেন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যে। এতে কক্সবাজারের পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসায় ফিরেছে চাঙ্গাভাব। সড়ক পথ ও আকাশপথের পর রেলপথযুক্ত হওয়ায় পর্যটনে খুলেছে নতুন দুয়ার। বিশেষ করে পর্যটকদের বিশেষ চাহিদা থাকায় ঢাকা-কক্সবাজার রোডে নিয়মিত ট্রেনের পাশাপাশি চালু করেছে পাঁচ দিনের জন্য বিশেষ ট্রেন। অনেকেই দীর্ঘদিন পর শুধুমাত্র ট্রেনের কারণেই কক্সবাজার এসেছেন। সব মিলিয়ে প্রাণ ফিরে এসেছে পর্যটনে।
রাজশাহীর আবুল কালাম নবদম্পতি সমুদ্রপাড়ে একে অপরের হাতে হাত রেখে বালিয়াড়িতে হাঁটছেন। জীবনের প্রথম হানিমুনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তারা পর্যটক শহর কক্সবাজারে এসেছেন। তাদের মতো এভাবে সমুদ্রের বিশালতার মাঝে মন মাতাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন অনেকেই। বসন্তের হিমেল পরশে পর্যটকদের আনন্দ-উন্মাদনায় ১৮ কিলোমিটার সৈকতজুড়ে বিরাজ করছে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে সাঁতার কাটাসহ সৈকতে দাঁড়িয়ে প্রিয়জনের সাথে সেলফি তুলে দিনটি স্মরণীয় করে রাখছেন পর্যটকরা।
স্থানীয় হোটেল কর্তৃপক্ষ আর জেলা প্রশাসন বলছে, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে গত দু’দিনে প্রায় চার থেকে পাঁচ লাখের মতো মানুষ পর্যটন শহরটিতে অবকাশ যাপনে গেছেন।’ এখানকার ৪০০-এর বেশি হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস, কটেজ ও রিসোর্টগুলো পর্যটকে কানায় কানায় পূর্ণ। হোটেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘এবার ব্যবসা হয়েছে খুবই ভালো। এবার কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসায় রমরমা বাণিজ্য হয়েছে বলে তারা জানায়।
শুধু হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস, কটেজ কিংবা রিসোর্ট নয়। জমজমাট ব্যবসা সৈকত এলাকার বার্মিজ মার্কেটগুলোতেও। ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় এখানে। বিশেষ করে বার্মিজ আচার, বাদাম, শামুক-ঝিনুকের ঘর সাজানোর উপকরণ এবং শুটকিসহ নানা পণ্যের কেনাবেচায় সরগরম দোকানগুলো। রিসোর্ট মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলছেন, ‘কক্সবাজারে পর্যটন সংশ্লিষ্ট খাতে দৈনিক দেড় শ’ কোটির টাকার ব্যবসা হচ্ছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘বিশ্বের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ও প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে দৈনিক বেড়াতে আসছে শোয়া লাখেরও বেশি পর্যটক। বিশেষ করে সপ্তাহের অন্যান্য দিনের চেয়ে শুক্রবার ও শনিবারসহ সরকারি ছুটির দিনে কোথাও তিল পরিমাণ ঠাঁই ছিল না সবখানেই ভরপুর পর্যটক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘সাপ্তাহিক ছুটির দিন, একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ধীরে ধীরে পর্যটক বাড়তে থাকে।
কলাতলিতে হোটেল সী উত্তরায় পর্যটকদের চাপ কেমন ছিল জানতে চাইলে ইনচার্জ আজাহার হোসাইন যে বর্ণনা দেন সেটা অনেকটা এমন-তিনি রাস্তায় এবং বিচের খোলা জায়গায় অনেক পর্যটককে রাত কাটাতে দেখেছেন। তিনি জানান, ‘পর্যটকদের সামাল দিতে স্থানীয় মসজিদগুলোও সারা রাত খোলা ছিল। যেখানে অনেক পর্যটক রাত কাটিয়েছেন। বেশিভাগ মানুষই আগে থেকেই হোটেলে রুম বুক না করেই চলে আসে। যার কারণে এ ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়।
তিনি আরো জানান, ‘আগে থেকে যদি রুম বুক করে আসতো বা যারা রুম পায়নি তারা যদি না আসতো, কিংবা পরে আসতো তাহলেই আর এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না। হোটেল ওয়ার্ড বিচ রিসোর্টের এক কর্মকর্তা ও টুয়াকের সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেন বলেন, ‘কক্সবাজার শহরে প্রচুর মানুষের ভিড় এবং এতো বেশি পরিমাণ পর্যটকের জন্য শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট লেগেছিল।
তিনি বলেন, ‘পর্যটকরা হোটেলে জায়গা না পেয়ে কম্বল নিয়ে রাস্তার আশপাশে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছে। এছাড়া যেসব রেস্তোরাঁ এবং রাত ১২টার পর বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা সেগুলোও সারারাত ধরে খোলা ছিল। পর্যটন সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি মার্চ মাসের ১২ তারিখ থেকে রমজান শুরু হওয়ায় মার্চের ১০ তারিখ পর্যন্ত পর্যটকে টইটুম্বুর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ বিনোদন কেন্দ্রগুলো ভীড় থাকছে। কেউ পরিবার নিয়ে, কেউ আসছে বন্ধুদের সাথে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে উপচে পড়া ভিড়।
হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা জানান, ‘এবারের আনাগোনা বেশ জমজমাট। সার্বিক নিরাপত্তায় প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছেন লাইফ গার্ড কর্মীরা। সৈকত ছাড়াও ভিড় বেড়েছে ইনানী, হিমছড়ি, রামু, মহেশখালী, টেকনাফের বিভিন্ন পর্যটন স্পট এবং সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘চার শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস রয়েছে। হোটেল ব্যবসা ছাড়াও রেস্তোরাঁ, শামুক, ঝিনুক, শুটকি, বার্মিজ পণ্য বিক্রিসহ অন্যান্য মিলে ফেব্রুয়ারি মাসে শত কোটি টাকার ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে পর্যটন ব্যবসায় মন্দা গেলেও গত ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে বাণিজ্যিকভাবে রেল চলাচল শুরুর পর পর্যটক খরা কাটতে শুরু করে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাড়তে থাকে পর্যটক। সরকারি এবং সাপ্তাহিক ছুটিতে এ সংখ্যা বাড়ে কয়েকগুণ। ২১শে ফেব্রুয়ারি বিকেলে সমুদ্র সৈকতের লাবনি পয়েন্ট, বঙ্গবন্ধু পয়েন্ট এবং কলাতলী পয়েন্টে পর্যটকদের ভিড় দেখা যায়। পর্যটকদের কেউ কেউ সৈকতের বালিয়াড়িতে ঘোড়ায় চড়ে, কেউ ছবি তুলে, কেউ বিচ বাইকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেকে সমুদ্রের নীল জলরাশিতে পা ভিজিয়ে নিচ্ছেন। তবে পর্যটকের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের ভিড়ও চোখে পড়ার মতো।
কক্সবাজার নাগরিক পরিষদের সভাপতি আ.ন.ম. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘কক্সবাজারের মানুষের স্বপ্ন রেললাইন। প্রধানমন্ত্রী সে রেললাইন দিয়ে কক্সবাজারের সাথে রেল চালু করে দিয়েছে। এটি কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের জন্য বিরাট একটি সুযোগ। শুধুমাত্র রেলপথ চালু হওয়ার কারণে পর্যটকের হার বাড়ছে দিন দিন। কিন্তু রেলের টিকেট যেভাবে কালোবাজারে চলে গেছে, তা পর্যটনের জন্য একটি দুঃসংবাদ। কালোবাজারমুক্ত করতে হবে রেলের টিকিট। সাধারণ পর্যটকরা যাতে পর্যাপ্ত টিকেট পায় সরকারকেই তার ব্যবস্থা করতে হবে।
টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিওনের অ্যাডিশনাল ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ‘কক্সবাজার আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কক্সবাজার রেলস্টেশনেও আমাদের টিম রয়েছে। রেল স্টেশন থেকে পর্যটকরা কক্সবাজার সৈকতে আসা পর্যন্ত যাতে সমস্যা না হয় সেখানে বিভিন্ন স্তরের টিম কাজ করে যাচ্ছে। সমুদ্র সৈকত ছাড়াও পর্যটন স্পটগুলোতে নিরাপত্তায় জোরদার করা হয়েছে। সাদা পোশাকেও আমাদের সদস্যরা কাজ করছে। তবে পর্যটকরা জেলা প্রশাসনের কর্মতৎপরতা এবং টুরিস্ট পুলিশের সহযোগিতা সন্তুষ্ট বলে জানান ।