মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যা এরই মধ্যে সবল ব্যাংককে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংক হেলথ ইনডেক্স অ্যান্ড হিট ম্যাপ’ প্রতিবেদনে সব মিলিয়ে ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯টিই লাল তালিকায় চলে গেছে। তবে নিজেদের করা এই প্রতিবেদন নিয়ে এখন ভিন্ন সুরে কথা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ১২টির অবস্থা খুবই খারাপ। যার মধ্যে ৯ ব্যাংক রয়েছে রেড জোনে।

দেশের ৬১ ব্যাংকের ১৬টির অবস্থা ভালো-বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন তথ্য প্রকাশের পর প্রশ্ন উঠেছে ঋণমান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম নিয়ে। ফলে অভিযোগ উঠেছে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য ভালো দেখাতে রেটিং এজেন্সিগুলো ঋণমান ভালো দেয়। সব মিলিয়ে তাদের করা রেটিং নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

এ বিষয়ে একাধিক ব্যাংকার জানান, একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, মূলধন পরিস্থিতি, মুনাফার অবস্থা, তারল্য পরিস্থিতি, ঋণ আমানত অনুপাত, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, পরিচালন ও বাজার ঝুঁকিসহ বিভিন্ন বিষয় দেখে এজেন্সিগুলোর রেটিং করার কথা। কিন্তু সেভাবে রেটিং হয় না। এখন যা হচ্ছে সবই ভুয়া রেটিং। এগুলো টাকার বিনিময়ে ঋণমান দেয়া হচ্ছে। ওদের রেটিংয়ে ব্যাংকগুলোর সঠিক চিত্র উঠে আসছে না।

দেশে বর্তমানে আটটি ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা রয়েছে। এগুলো হলো ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (ক্রিসল), ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অব বাংলাদেশ (ক্র্যাব), ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড (ইসিআরএল), ন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড (এনসিআরএল), আর্জুস ক্রেডিট রেটিং সার্ভিসেস লিমিটেড, আলফা ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড, ডব্লিউএএসও ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি ও দ্য বাংলাদেশ রেটিং এজেন্সি লিমিটেড।
অপরদিকে, রেটিং এজেন্সির ওপর চাপ প্রয়োগসহ বিভিন্ন কৌশলে ভালো রেটিং বা ঋণমান করিয়ে নেয়ার অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে এসেছে।

গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্বয়ং ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিস ইন বাংলাদেশ (এসিআরএবি) আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছিল। সেখানে বলা হয়, অনেক ব্যাংক উচ্চতর রেটিং দেয়ার জন্য ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলোর কাজে হস্তক্ষেপ করছে। এরপর গত বছরের ২ এপ্রিল সব ব্যাংকের এমডিকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় এ বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়, এ ধরনের প্রবণতা রোধ করা না গেলে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসাবায়নের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হেলথ ইনডেক্স অ্যান্ড হিট ম্যাপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, রেড জোন বা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় থাকা ৯টি ব্যাংকের মধ্যে এবি ব্যাংকও রয়েছে। কিন্তু রেড জোনে থাকা এবি ব্যাংক ক্রেডিট রেটিংয়ে সর্বোচ্চ ঋণমান বা ‘১’ রেটিং পেয়েছে।

এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর মেহমুদ হোসেন বলেন, এত অসামাঞ্জস্য কীভাবে হলো এবং কীসের ভিত্তিতে এমন রেটিং করেছে সেটি সংশ্লিষ্ট রেটিং এজেন্সি বলতে পারবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এজেন্সিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে ঋণমান বাড়িয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে। গভর্নরও একবার এমডিদের এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। এমডিরা ব্যাংকে চাকরি করেন। তারা একটি বোর্ডের অধীনে আছেন। কিন্তু রেটিং এজেন্সিগুলো তো কোনো বোর্ডের অধীনে চাকরি করেন না। তারা তো স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও উচিত তাদের কাছে জবাব চাওয়া।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে রেড জোন বা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক ক্রেডিট রেটিংয়ে দ্বিতীয় মানের ঋণমান বা ‘২’ রেটিং পেয়েছে। রেকর্ড লোকসান, পরিচালনায় ব্যাপক হস্তক্ষেপসহ চরম খারাপ অবস্থার কারণে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও ব্যাংকটির রেটিং দেয়া হয়েছে ‘২’। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যাংকাররা।

এ ছাড়া রেড জোনে থাকা পদ্মা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান তৃতীয় মানের ঋণমান বা ‘৩’ রেটিং পেয়েছে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনটি বাণিজ্যিক ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ইয়েলো জোনে পড়লেও ব্যাংকগুলোর অবস্থান রেড জোনের কাছাকাছি। ব্যাংকগুলো চরম খারাপ অবস্থার কাছাকাছি থাকলেও ক্রেডিট রেটিংয়ে এগুলোকেও দ্বিতীয় ঋণমান বা ‘২’ রেটিং দেয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে কথা বললে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের দেশের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো একেবারে নির্ভরযোগ্য নয়। তারা মুডিসের মতো না। এগুলোর কোনো গুণগত মান নেই। পয়সা দিয়ে সব রেটিং কেনা যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রেটিং এজেন্সিগুলোকে আবার রেট করা দরকার। তারা রেট করার যোগ্য নয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত তাদের রেট করা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় আছে বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অবশ্যই দায় আছে। একটি রেটিং এজেন্সি খারাপকে ভালো করবে আর ভালোকে খারাপ করবে, এটি কী উচিত? এসব দেখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইয়েলো জোনে রয়েছে আরও ২৬টি ব্যাংক।

হেলথ ইনডেক্স অ্যান্ড হিট ম্যাপের প্রতিবেদনে এগুলোকে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এই দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ব্যাংকই ক্রেডিট রেটিংয়ে সর্বোচ্চ ঋণমান পেয়েছে। এর মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ওয়ান ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক ও সাউথ ইস্ট ব্যাংক সর্বোচ্চ ঋণমান বা ‘১’ রেটিং পেয়েছে।

এ ছাড়া এনআরবি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক এবং সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক দ্বিতীয় ঋণমান বা ‘২’ রেটিং পেয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকগুলোর ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাটমেন্টের ওপর ভিত্তি করে রেটিং এজেন্সিগুলো ক্রেডিট রেটিং করে থাকে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের কোনো রেগুলেটরি নয়। তাদের পারমিশন দিয়েছে বিএসইসি। কোনো অভিযোগ থাকলে জবাবদিহি তাদের কাছে করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পুনঃতফসিল, করোনা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে আদায় না করেও নিয়মিত দেখানোসহ বিভিন্ন শিথিলতার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র সামনে আসছে না। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো কাগজে কলমে খেলাপি দেখিয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। আইএমএফের শর্তের আলোকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি বা মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ দুর্দশাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০২২ সাল শেষে ১০ শতাংশের কম মূলধন ছিল ১১টি ব্যাংকের। সাড়ে ১২ শতাংশের নিচে ছিল আরও পাঁচটি ব্যাংকের। সাড়ে ১২ থেকে ১৫ শতাংশের নিচে ছিল ১৬টি ব্যাংকের। ১৪টি ব্যাংকের ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে এবং ১৫টি ব্যাংকর মূলধন ছিল ২০ শতাংশের ওপরে।