ভারতীয় পণ্য বর্জন ইস্যুতে বাকযুদ্ধে আ’লীগ-বিএনপি
আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বাংলাদেশে রাজনীতিতে বেশ জমে উঠেছে ‘ভারত ইস্যু’, বিশেষ করে বিরোধী দল বিএনপি ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক চলছে। ভারত নিয়ে প্রকাশ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
মুলত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুমাসের বেশি সময় পর জোরেশোরে ভারতবিরোধী আন্দোলনে নেমেছে বিএনপি। প্রকাশ্যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে দলটি। তবে নির্বাচনের পরপর এই কর্মসূচি শুরু করেছিল বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র দু-একটি ছোট দল। তখন বিএনপি এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেনি। কিন্তু সম্প্রতি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিজের ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে এ আন্দোলনে নতুন মাত্রা দেয়ার চেষ্টা করেন।
কিন্তু নির্বাচনের পর বিএনপির প্রকাশ্যে ভারত বয়কটের ডাক কেন? বিএনপির ভাষায়: গেল নির্বাচনে ভারত প্রভাব বিস্তার করেছে। সুতরাং ভারত বয়কটের ডাক তাদের। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গেল নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতারা ঢাকায় বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের দূতাবাস কিংবা হাইকমিশনে নিয়মিত হাজিরা দিয়েছেন।
কোনো কোনো প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতরা প্রকাশ্যে এমন সব কর্মকাণ্ড করেছেন কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন যেটি পরোক্ষে বিএনপির পক্ষে গেছে। এ নিয়ে বিএনপির মধ্যে তখন খুশি-খুশি ভাব ছিল। কিন্তু বরাবরই বলে এসেছে: নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণ কাকে ভোট দেবে সেটি তাদের ব্যাপার। তবে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে তারা চায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।
এ বিষয়টি সামনে এনে বিশ্লেষকদের মত: বিএনপি কি তবে চেয়েছিল, ভারত তাদের হয়ে আওয়ামী লীগকে চাপ দিক? আর সেটি না হওয়াতেই ভারতের ওপর ক্ষুব্ধ তারা?
এ কারণে ভারতীয় পণ্য বয়কটের নামে বিএনপি বাজার ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করতে চায় বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। চাদর পোড়ানোসহ নেতাদের ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডকে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব আখ্যা দিয়ে কার স্বার্থে বিএনপি এমন আচরণ করছে, এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইসফাক এলাহী চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ভারত ও ভারতীয় পণ্য প্রসঙ্গে যেভাবে বাগযুদ্ধে নেমেছে এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র; তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখলে আমাদের জন্যই ভালো। পণ্য প্রসঙ্গ নিয়ে যেভাবে রাজনীতিতে কথা কাটাকাটি চলছে তা আমাদের দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অংশ। নিজেদের মধ্যে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সবাই রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চাইছে। এতে ভারত বাংলাদেশ নিরাপত্তা কিংবা বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না।
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের কিছুদিন পরই ‘ইন্ডিয়া আউট’ বা ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ বিরোধী বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এটি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গত ২০ মার্চ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিজের ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে এ আন্দোলনে সংহতি জানান। যদিও পরে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলেছেন, এটি তার ব্যক্তিগত বক্তব্য।
এরই মধ্যে গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এতে রুহুল কবির রিজভীর ওই কর্মকাণ্ড তুলে ধরে আলোচনা করা হয়। ভারতীয় পণ্য বর্জনে রিজভীর সংহতি জানিয়ে দেয়া বক্তব্য ব্যক্তিগত বলে স্থায়ী কমিটিতে জানানো হয়েছে। তবে কৌশলের অংশ হিসেবে তারা ভারতের পণ্য বর্জনের আন্দোলনে দলগতভাবে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে চায় না। আগামী বৈঠকে এটি নিয়ে আরও বিস্তর আলোচনা, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের পর এ বিষয়ে বিএনপি দলীয় অবস্থান ঠিক করবে বলে জানা গেছে।
গত সোমবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, রক্তের দামে কেনা বাংলাদেশ কোনো দেশের প্রভুত্ব মানবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশ যদি মনে করে, আমাদের ওপরে প্রভুত্ব করবে, তাদের জেনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন সেই প্রভুত্ব স্বীকার করেনি। মোগল আমলে করেনি, ব্রিটিশ আমলে করেনি, পাকিস্তান আমলে করেনি, এখনো করবে না।’
এদিকে গত বুধবার এ বিষয়ে বিএনপি নেতাদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিএনপির এক নেতা দেখলাম চাদর খুলে পুড়ল। আমি এখন বলব, বিএনপি নেতারা যদি বাসায় গিয়ে বউদের ভারতীয় শাড়ি পোড়ান, সেদিন বিশ্বাস করব তারা সত্যি ভারতীয় শাড়ি বর্জন করলেন। ভারতীয় মসলা তারা খেতে পারবে কি না, এ উত্তর তাদের দিতে হবে।
আপনারা এ পণ্য সত্যি বর্জন করছেন কি না, এ কথাটাই আমরা জানতে চাই। শেখ হাসিনা বলেন, যে নেতারা বলছেন ভারতীয় পণ্য বর্জন করবেন, তাদের বউদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে? ঈদের আগে দেখতাম, বিএনপির মন্ত্রীদের বউরা ভারত থেকে শাড়ি এনে বিক্রি করত।’
বিএনপি নেতারা কেন স্ত্রীদের ভারতীয় শাড়ি পোড়াচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রশ্নের জবাবে গত বৃহস্পতিবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপির নেতারা ইন্ডিয়া থেকে শাড়ি খুব একটা কেনে না। আমার নানাবাড়ি ভারতে। বিয়ের পর একবার ভারত গিয়েছিলাম মামাবাড়ি। সেখান থেকে আমার স্ত্রীকে একটা শাড়ি দিয়েছিল। সেটা অনেক আগেই কাঁথা বানানো হয়েছে, সেটাও ছিঁড়ে গেছে।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘চিরাচরিত পাকিস্তানি কায়দায় ভারতের বিরোধিতা শুরু করেছে বিএনপি। তারা যখন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না পায়, তখনই এ একটা ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর আমলেও করেছে, এখন শেখ হাসিনার আমলে এবারও তাই করছে। বয়কট ইস্যুতে বিএনপি নেতাদের ঐক্য নেই দাবি করে তিনি বলেন, বয়কট আন্দোলন করছে তারা। কিন্তু তাদের নিজেদের বক্তব্যে মিল নেই।’
ভারতের আনুগত্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ চালাচ্ছে অভিযোগ তুলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আজকে একটি রাষ্ট্রের প্রতি নতজানু যে পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতি বিষয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা এটা বর্তমান শাসক দলের অভ্যাস। তাদের সাধারণ সম্পাদক (ওবায়দুল কাদের) যখন বিপদে পড়ে তখন বলেন যে, দিল্লি আছে আমরা আছি।
এ ধরনের কথা বলতে লজ্জাবোধও তাদের হয় না। দিল্লি থাকলে এ সরকার আছে। কতখানি নির্লজ্জ প্রতিবেশী দেশের আশ্রয়ে আনুগত্য স্বীকার করে যাচ্ছে। আমরা কি এজন্য যুদ্ধ করেছি? রাওয়ালপিন্ডি থেকে সরে এসে আমরা কি দিল্লির অধীনস্থ হওয়ার জন্যই যুদ্ধ করেছি? কখনই না। বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা মানুষ কখনই এ ধরনের গোলামি মেনে নেবে না।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, ‘জনবিচ্ছিন্ন হয়ে বিএনপি এখন সস্তা ইস্যু তৈরি করতে ভারতীয় পণ্য এবং দেশটির বিরোধিতা করছে।’ ‘ইন্ডিয়া আউট’ মানেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে আহ্বান জানানো বলে মন্তব্য করেছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘আজ এই দেশ থেকে ইন্ডিয়া আউট, ভারত আউট কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। যারা ভারতবিরোধী স্লোগান দিচ্ছে, ইন্ডিয়া আউট বলছে- তারা আজ বাংলাদেশের জনগণ থেকে আউট হয়েছে। তারা পাকিস্তানপন্থি এবং পাকিস্তানের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।’
আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য, এমন মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, এটা বর্জন করলেই শেষ। গত শুক্রবার এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। গয়েশ্বর বলেন, ‘আজ ভারতের সবচেয়ে বড় পণ্য হলো আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা। এটা বর্জন করলেই শেষ। বর্জন করার তো করছেই, এখন এটাকে তাড়ানো যায় কি না। তাহলেই তো শেষ।
এ একটা পণ্য বর্জন করলেই তো জাতির মুক্ত হওয়া সম্পন্ন। অন্য পণ্য বর্জন করার প্রয়োজন হয় না আমাদের। তিনি আরও বলেন, ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সারা গণতান্ত্রিক বিশ্বের মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল, ভারত যদি পাশে না থাকত, তাহলে আমরা ৭ তারিখের আমি, ডামি, স্বামী, সমকামী নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারতাম না। এজন্যই এই ঝামেলা শুরু হয়েছে।’
জানা গেছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে দফায় দফায় বিএনপির প্রতিনিধি দল ভারত সফরে গিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে। ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও ভারতবিরোধী কোনো অবস্থান নেয়া হবে না বলে সে সময় দলটির পক্ষ থেকে বার্তা দেয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফরে গিয়ে ‘ভারতের সঙ্গে বিএনপির বৈরী আচরণ ভুল ও বোকামিপূর্ণ ছিল’ বলে স্বীকার করে।
তখন থেকেই মনে করা হয়েছিল এর মাধ্যমে দলটি ভারতবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসেছে। সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরও বিএনপি ভারতের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে। ভারতের বিষয়ে অনেকদিন ‘নরম সুর’ দেখায় তারা।
যাতে ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভারত নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়, কোনো দলের পক্ষে অবস্থান না নেয় এমনটিই চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে চাহিদামতো সুবিধা না পেয়ে বিএনপি নেতারা আগের অবস্থানে ফিরে যেতে চাইছেন বলে পর্যবেক্ষকমহল ধারণা করছেন।