ঈদযাত্রায় স্বস্তির বার্তা, আছে শঙ্কাও, বেরোনোর পথে যানজটের ‘কাঁটা’
আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: লম্বা ছুটি থাকায় গত দুই বছরের মতো মহাসড়কে স্বস্তির ঈদযাত্রা আশা করা হলেও রাজধানী ঢাকা থেকে বেরোনোর পথে ভোগান্তির শঙ্কা রয়েছে। শেষ কর্মদিবসে যাত্রীর ঢল নামলে আগের দুই বছরের মতো এবারও নগর ছাড়তে তীব্র যানজটে ভুগতে হতে পারে। ৯ এপ্রিল ছুটি না থাকলে মহাসড়কের অবস্থা যতই ভালো থাকুক, একসঙ্গে ঘরমুখো মানুষের ঢলে ঈদের আগের দিন গাড়ির জটে যন্ত্রণার যাত্রা হতে পারে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) মহাসড়কের ১৫৫ স্থানকে যানজটপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতি নামের বেসরকারি সংস্থার ভাষ্যানুযায়ী, যানজট হতে পারে ৭১৪ স্পটে। সড়কপথে ঈদযাত্রায় ছয় মহাসড়কে দুর্ভোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এবং ঢাকা বাইপাস সড়কে ১৫টি যানজটের স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে।
উত্তরের ১৬ জেলার যাত্রীদের জন্য বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর অংশে ১৭ কিলোমিটার সড়ক নিয়ে দুঃশ্চিন্তা যেন কাটছেই না। দক্ষিণে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের সাত কিলোমিটার অংশ বেহাল থাকায় ঘরে ফেরা মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হবে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের করিডোর খ্যাত টঙ্গীতে ছয় স্থানে হতে পারে দুর্ভোগ। আর তিন কারণে টাঙ্গাইলে ১৩ কিলোমিটার পথে ভোগান্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় নিরাপদ ঈদযাত্রায় সাতটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ২১ মার্চ ঈদ প্রস্তুতি সভায় এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বৈঠকে ঈদযাত্রায় যানজট কমাতে সেতুগুলোতে টোল ফ্রি করার প্রস্তাব দেন বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিরা। সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো হলো- সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো ঈদের দিনসহ এর আগের ৭ দিন এবং পরের ৫ দিন সার্বক্ষণিক খোলা রাখা।
তবে এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তির হবে এমটাই আশা করছেন বাস ও লঞ্চ মালিকরা। একই আশ্বাস দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও। তবে টানা দীর্ঘ ছুটির কারণে এবারের ঈদে সড়ক, নৌ, রেল ও বিমানপথে যাত্রীদের বাড়তি চাপ পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২৬ পয়েন্টকে শঙ্কা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কে আটটি পয়েন্ট এবং ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের বেশ কিছু পয়েন্ট যাত্রীদের জন্য দুর্ভোগের কারণ হতে পারে। তাছাড়া সারা দেশের সঙ্গে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর সড়ক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কে বড় ধরনের বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগ নিয়ে শঙ্কিত পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে ঈদযাত্রায় স্বস্তির বার্তার সঙ্গে আছে শঙ্কাও। এদিকে ভোগান্তি কমাতে অনেকেই এবার আকাশপথকে বেছে নিচ্ছেন। বাড়তি এ চাপ সামলাতে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট বাড়াতে পারে বিমান বাংলাদেশসহ বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো।
প্রায় ১১ দিনের লম্বা ছুটির সম্ভাবনার কারণে এবার ঈদে সবচেয়ে বেশি মানুষ গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে পারে। দেশের সড়কপথের অবস্থা ভালো হওয়ায় যাত্রীর চাপ অনুযায়ী পর্যাপ্ত সংখ্যক বাস চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে শেষ সময়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে সড়ক পরিবহন কোম্পানিগুলো। ব্যবসা মন্দা থাকলেও ঈদের সময় লোকসান পুষিয়ে নিতে প্রস্তুত হয়ে আছেন লঞ্চ মালিকরা।
ঈদ উপলক্ষে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করেছে সরকারি পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ে। দূরপাল্লার রুটে যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) পাঁচ শতাধিক বাস। এদিকে দেশের মহাসড়কগুলোর অবস্থা ভালো থাকায় যাত্রীদের ভোগান্তি কম হবে বলে জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। মহাসড়কে যানজট পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিকল্পনা নিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবারের ঈদযাত্রা পুরোপুরি স্বস্তিদায়ক হবে বলে আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় বিগত বছরগুলোতে ঈদযাত্রায় কিছুটা ভোগান্তি হয়েছে। এবার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কে আর কোনো ভোগান্তি পোহাতে হবে না।
প্রকল্পের সওজের অংশের আওতায় নির্মিত সাতটি ফ্লাইওভার যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। এর ফলে এবার ময়মনসিংহের পথে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হবে। ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে আমরা বৈঠক করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঈদের আগে ও পরে ট্রাক-ভারী পরিবহন চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সবাই যদি নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে তাহলে এবার মহাসড়কে যানজট থাকবে না। অন্যান্য মহাসড়কের অবস্থাও ভালো।’ সড়কপথ: সড়কপথে এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তির হবে বলে সবাই আশা করছেন। এখনো সড়ক পথে যাত্রীর চাপ বাড়েনি। বড় বড় বাস কোম্পানি অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরু করেছে। তবে কাউন্টারগুলোতে টিকিটপ্রত্যাশী যাত্রীর দেখা মিলছে কম। তবে ঈদের ক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
শ্যামলী এন আর ট্রাভেলসের কর্মী কামাল হোসেন জানিয়েছেন, ‘ঈদ ঘনিয়ে এলেও টিকিট বিক্রিতে কোনো চাপ নেই। অনেকেই অনলাইনে অগ্রিম টিকিট আমাদের কল্যাণপুর কাউন্টার থেকে নিচ্ছে। তবে অনলাইনেও এখনো যাত্রীর চাপ আশানুরূপ হয়নি। ১ এপ্রিল থেকে বাসের টিকিট বিক্রির চাপ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ যাত্রীরা প্রথমেই রেলের টিকিট সংগ্রহের চেষ্টা করে। রেলের টিকিট না পেলে তখন বাসের টিকিটের জন্য ছোটে। ১ বা ২ এপ্রিলের মধ্যে সবাই বেতন ও বোনাস পাবে। তখন টিকিট কাটা শুরু করবে। ৫ অথবা ৬ এপ্রিল থেকে ঈদযাত্রা শুরু হবে।
যাত্রীর চাপ ও সড়কের অবস্থার ওপর নির্ভর করে গাড়ি ছাড়া হবে। আগেই অতিরিক্ত টিকিট ছাড়া হবে না। রাস্তায় যানজট হলে গাড়ি শিডিউল বিপর্যয়ে পড়বে। তখন গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে দেয়া হবে। রাস্তায় যানজট না থাকলে স্পেশাল ও অতিরিক্ত সার্ভিসের জন্যও পর্যাপ্ত বাস প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে শঙ্কার ২৬ পয়েন্ট: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে প্রতিবছর ঈদে ঘরমুখো মানুষকে যানজটের কবলে পড়তে হয়। সড়কে যানবাহনের চাপ, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা ও গাড়ি পার্কিংয়ের ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তবে এবারের ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে মহাসড়কের কুমিল্লার অংশ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে বিশেষ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
যানজটের কারণ এবং যানজটপ্রবণ ২৬টি পয়েন্ট চিহ্নিত করেছে হাইওয়ে পুলিশ। সূত্র জানায়, এ মহাসড়কে যুক্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ ১০ জেলা। গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়ক দিয়ে কয়েক লাখ মানুষ ঈদ উপলক্ষ্যে বাড়ি ফিরবে। এ ঈদযাত্রায় যেন সাধারণ মানুষের ভোগান্তি না হয় এবং নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে সে কারণেই এসব উদ্যোগ পুলিশের।
মহাসড়কের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান চিহ্নিত: ঈদ ঘিরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কিছু এলাকায় আগে যানজট সৃষ্টি হতো। বর্তমানে যানজট কমেছে। তারপরও সব বিষয় বিবেচনা করে এ মহাসড়কের অধিক গুরুত্বপূর্ণ ১২টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্থান হলো- বলদাখাল বাসস্ট্যান্ড, গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড, চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড, নিমসার বাজার ও ইউটার্ন, ক্যান্টনমেন্ট মোড় (উভমুখী), আলেখারচর বিশ্বরোড, বিসিক মোড় চৌদ্দগ্রাম, লালপোল, ভাটিয়ারী পয়েন্ট, ফৌজদারহাট ইউটার্ন, সীতাকুণ্ড বাসস্ট্যান্ড, বড় দারোগারহাট স্কেল।
এসব স্থানে অতিরিক্ত টহল ও বাড়তি নজরদারিতে রাখবে হাইওয়ে পুলিশ। এ ছাড়া তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ ১৪টি স্থান হিসেবে শহীদনগর বাসস্ট্যান্ড আমিরাবাদ বাসস্ট্যান্ড, ইলিয়টগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড, মাধাইয়া বাসস্ট্যান্ড, কোটবাড়ি ইউটার্ন, জাগুরঝুলি কাটা, নূরজাহান হোটেলের সামনের ইউটার্ন, সদর দক্ষিণ থানার সামনের ইউটার্ন, সুয়াগাজী বাজার (উভমুখী), নাজিরা বাজার ইউটার্ন, বাড়বকুন্ড বাজার, ছোট কুমিরা, কেডিএস মোড়, ফুটলিং এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে।
যে কারণে যানজটের আশঙ্কা: হাইওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় কমিউনিটি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মহাসড়কের যানজটের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে মহাসড়কের পাশে অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা নির্মাণ, মহাসড়কে যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা, অবৈধ পার্কিং, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করা, উল্টোপথে গাড়ি চালনা, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, পণ্যবাহী গাড়িতে ওভার লোডের কারণে ধীরগতি, পথচারীদের অসচেতনতা, টোলপ্লাজায় ধীরগতিতে টোল আদায়, দুর্ঘটনার কারণে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া, ত্রুটিপূর্ণ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি মহাসড়কে বিকল হয়ে যাওয়া, সড়ক পরিবহন আইন অমান্য করে গাড়ি চালনা, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত গাড়ি চালনার ফলে যানজট লেগে থাকে।
হাইওয়ে পুলিশের উদ্যোগ: মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত যান চলাচল স্বাভাবিক করতে অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি প্রস্তুত রয়েছে বিশেষ কুইক রেসপন্স টিম। সড়কজুড়ে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছে কমিউনিটি পুলিশ। কুমিল্লা রিজিয়নে হাইওয়ে সেক্টর থাকবে দুটি ও সাব সেক্টর ২১টি, মোবাইল ডিউটি থাকবে ৩৪টি, পিকেট ডিউটি ১৫টি, কুইক রেসপন্স টিম মোটরসাইকেলযোগে থাকবে ১৫টি, পিকআপযোগে ১৫টি, স্ট্রাইকিং রিজার্ভ একটি, রেকার ডিউটি সরকারি পাঁচটি ও বেসরকারি ছয়টিসহ সর্বমোট ১১টি,
অ্যাম্বুলেন্স ডিউটি দুটি, কন্ট্রোলরুম একটি, অস্থায়ী কন্ট্রোলরুম বা ওয়াচ টাওয়ার থাকবে ৩৫টি। এভাবে সব পদের সর্বমোট ৬৮০ জন পুলিশ ও ৩৫০ জন কমিউনিটি পুলিশিং সদস্য সার্বক্ষণিক মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে মহড়া দেবে। একই সঙ্গে জেলা পুলিশ মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী থানা এলাকায় যেখানে সড়কে নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য সড়ক ও জনপথের স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা কাজ করছেন। যানজটমুক্ত, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অতিরিক্ত ব্যবস্থার পাশাপাশি মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাই রোধে নেয়া হয়েছে বিশেষ সতর্কতা ব্যবস্থা।
ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কে বিড়ম্বনার আভাস: আসন্ন ঈদুল ফিতরে সারা দেশের সঙ্গে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর সড়ক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কে বড় ধরনের বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগ নিয়ে শংকিত পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। ঘরমুখী এবং ঈদপরবর্তী কর্মস্থলমুখী মানুষের বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগ নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বরিশাল ও সন্নিহিত এলাকার সঙ্গে রাজধানীসহ প্রায় সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ রক্ষাকারী বরিশাল-ফরিদপুর জাতীয় মহাসড়কটিতে যানবাহনের সংখ্যা প্রায় চারগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু ঢাকা থেকে ছয় লেনের বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পদ্মা সেতু পার হয়ে ৬৫ কিলোমিটার দূরে ভাঙ্গায় পৌঁছানোর পর বরিশাল পর্যন্ত ২৪ ফুট প্রশস্ত ৯১ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কে তীব্র যানজট ও দুর্ঘটনা এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
এদিকে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. শাহাবুদ্দিন খান জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইতোমধ্যেই ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মহাসড়কে কোনো গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরানোর ব্যবস্থা থাকবে। ঈদযাত্রা শুরুর পর থেকেই সব মহাসড়কে পুলিশের ২৪ ঘণ্টা টহল থাকবে। পাশাপাশি থানা পুলিশকেও কাজে লাগানো হবে।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি বলেছে, লঞ্চগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসামগ্রী নেই। এমনকি অনেক লঞ্চে নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। লঞ্চের ডেকে অতিরিক্ত যাত্রীর পাশাপাশি ছাদে ও কেবিনগুলোর সামনেও যাত্রী বহন করা হচ্ছে। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়। তবে প্রতিবারের মতো এবারের ঈদে ফিটনেসবিহীন একটি লঞ্চও চলতে দেয়া হবে না বলে হুঙ্কার দিচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ। নৌপথ: নৌপথে ঈদযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে লঞ্চ মালিক ও বিআইডব্লিউটিএ।
ঈদের ছুটি লম্বা হওয়ায় এবার নৌপথে যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লঞ্চের কেবিন বুকিংয়ে যাত্রীদের বেশ সাড়া মিলেছে। ইতোমধ্যেই ৫০ শতাংশ কেবিন বুকিং হয়েছে বলে জানা গেছে। লঞ্চ মালিকরা বলছেন, ৫ অথবা ৬ এপ্রিল থেকে ঈদযাত্রা শুরু হবে। কেবিন বুকিং শুরু হলেও এখনো যাত্রীদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া মিলছে না। আগামী ৫ অথবা ৬ এপ্রিল থেকে লঞ্চের যাত্রী বাড়বে।
গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেশির ভাগই একেবারে শেষ সময়ে ছুটি পায়। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন নৌরুটে সদরঘাট থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে ৮০টি লঞ্চ চলাচল করবে। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত বয়া, লাইফ জ্যাকেটসহ সব সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে নৌপথের ঈদযাত্রা এবার স্বস্তির হবে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ১৩ কিলোমিটারে যানজটের আশঙ্কা : দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক। ঈদসহ যে কোনো উৎসবের ছুটিতে এ মহাসড়কে যানজট এবং ভোগান্তি নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে টাঙ্গাইল পুলিশ প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগে স্বস্তিতেই বাড়ি ফিরছে ঘরমুখো মানুষ। এবারো নেওয়া হয়েছে যথাযথ পদক্ষেপ। ভোগান্তি দূর করতে উত্তরবঙ্গগামী গাড়িগুলো ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ওয়ানওয়ে (একমুখী) চলাচল করবে।
ঢাকাগামী যানবাহন বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে গোলচত্বর দিয়ে ভূঞাপুর হয়ে এলেঙ্গা প্রবেশ করবে। এতে করে যানজট অনেকটা কমে যাবে। মহাসড়কে সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা থেকে যানবাহনগুলো চারলেন সড়কের সুবিধায় টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পর্যন্ত অতি দ্রুত আসতে পারে। কিন্তু এলেঙ্গার পর থেকে সেতু পর্যন্ত সড়ক দুই লেন। চার লেনের যানবাহন দুই লেন সড়কে প্রবেশের সময় যানজটের সৃষ্টি হয়। সেতু পূর্ব ১৩ কিলোমিটার মহাসড়কে যানজট গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া এলেঙ্গা থেকে ভূঞাপুর পর্যন্ত আঞ্চলিক সড়কেও রয়েছে একাধিক খানাখন্দ। ফলে ঢাকামুখী যান চলাচলে হতে পারে বিঘ্ন। এলেঙ্গা থেকে সেতুর দিকে মহাসড়কে ফোরলেনে কাজ চলছে ধীরগতিতে।
উত্তবঙ্গগামী চালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঢাকা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত আসতে কোনো সমস্যা হয় না। তবে এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত যেতে যানজট লাগে। গাড়ি ওভারটেকিং ও বিকল হওয়ার ফলে যানজট লেগে যায়।’
টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সিনথিয়া আজমিরী খান বলেন, ‘ঈদে ঢাকামুখী যানবাহনগুলো ভূঞাপুর-এলেঙ্গা আঞ্চলিক সড়ক হয়ে চলাচল করে। এখানে খানাখন্দগুলো ঈদের আগেই মেরামত করা হবে।’
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, ‘এলেঙ্গা থেকে সেতু পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার উত্তরবঙ্গগামী যানবাহন একমুখী চলবে। আর উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী যানবাহন সেতু পার হওয়ার পর বিকল্প সড়ক হিসেবে গোলচত্বর থেকে উত্তর দিকে ভূঞাপুর হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুর্ভোগ লাঘবের জন্য যাত্রীরা যানজটে আটকা পড়লে মহাসড়কের পাশে পেট্রোল পাম্প, হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে যাতে শৌচাগার ব্যবহার করতে পারে সে জন্য তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ২৫টি অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ইফতার ও সাহরিতে যাতে অসুবিধা না হয় সে জন্য এলেঙ্গা থেকে সেতু পর্যন্ত যানজট হলে আটকেপড়া মানুষের মাঝে পানি, শুকনা খাবার সরবরাহের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, এবার ঈদে ৭০০ পুলিশ মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করবেন। অনেক সময় ঈদের আগের দিন রাস্ত তুলনামূলকভাবে ফাঁকা হয়ে যায়। অনেক ব্যবসায়ীরা ফাঁকা রাস্তায় ছিনতাইকারী বা মলম পার্টির খপ্পরে পড়তে পারে। সে জন্য সব পুলিশ ঈদের সাত দিন আগ থেকে ঈদের পরের দুদিন পর্যন্ত হাইওয়েতে দায়িত্ব পালন করবে।
রেলপথ: এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে বাংলাদেশ রেলওয়ে সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি করছে। রেলস্টেশনে নেই কোনো চাপ। ট্রেনের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হবে বলে জানিয়েছেন, রেলওয়ের কর্মকর্তারা। ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্নে করতে রাজধানীর কমলাপুর, বিমানবন্দর, তেজগাঁও এবং জয়দেবপুরসহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা স্টেশনে বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে বিনা টিকিটের যাত্রী ঠেকানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
একজন যাত্রীকে চারস্তরে টিকিট পরীক্ষা করে তবেই ট্রেনে উঠতে দেয়া হবে। রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম জানিয়েছেন, ঈদে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রায় ১০০টি নতুন বগি প্রস্তুত করা হচ্ছে- যা ঈদযাত্রা বহরে যুক্ত হবে। রেল বহরে রাখা হচ্ছে মোট ২৫০টির মতো ইঞ্জিন। শিডিউল বিপর্যয়ে প্রয়োজনে একটি বা দুটি বাড়তি রেক (কয়েকটি কোচের সমন্বয়ে তৈরি বিকল্প ব্যবস্থা) প্রস্তুত থাকবে। যাতে কোনো ট্রেন অতিরিক্ত লেট করলে এ রেক দিয়ে শিডিউল বিপর্যয় রোধ করা যায়। শিডিউল বিপর্যয়সহ নাশকতা, দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মোবাইল টিম কাজ করবে।
তিনি জানান, গত ঈদে ৩০ হাজার যাত্রী বহন করলেও এবারে প্রায় ৫০-৬০ হাজার যাত্রী প্রতিদিন ট্রেনে করে বাড়ি যেতে পারবেন। এদিকে ফিরতি যাত্রায় ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হবে ৩ এপ্রিল। ওই দিন পাওয়া যাবে ১৩ এপ্রিলের টিকিট। এভাবে ৯ এপ্রিল ১৯ এপ্রিলের ফিরতি টিকিট বিক্রি করবে রেলওয়ে। রেল সচিব ড. হুমায়ূন কবীর বলেন, এবার মোট ২৪৮টি লোকমোটিভ প্রস্তুত করা হয়েছে, অতিরিক্ত ৮৬টি বগি রেল বহরে যুক্ত হবে। ঈদ উপলক্ষে সব ট্রেনের অফ ডে বাতিল করা হয়েছে, কর্মীদের ছুটি বাতিল করা হবে এবং আন্তঃদেশীয় মৈত্রী, মিতালী ও বন্ধন এক্সপ্রেস ৭ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখা হবে। আর কোনো যাত্রী যাতে ছাদে উঠতে না পারে সে জন্য বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক থাকবে।
বিমানপথ: এদিকে এয়ারলাইন্সগুলো জানায়, পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটের টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ ৯ ও ১০ এপ্রিল ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছেন। সব মিলিয়ে ৭ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত চাপ থাকবে। যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপের কারণে ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানো হবে। এবার যশোর ও বরিশাল রুটে টিকিটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ফেরিঘাটে ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনেকে এই রুটে আকাশপথকে বেছে নিচ্ছেন। এ ছাড়া যানজটের শঙ্কায় সৈয়দপুর ও রাজশাহীর মতো রুটেও আকাশপথ বেছে নিচ্ছেন যাত্রীরা।
এদিকে আসন্ন ঈদে যাতায়াতে দুর্ভোগ, পথে পথে যাত্রী হয়রানি, ভাড়া নৈরাজ্য ও সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ঈদের ছুটি দুদিন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। ঈদযাত্রা নিরাপদ ও ভোগান্তিমুক্ত করতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ৯ ও ১০ এপ্রিল প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ লাখ হারে মানুষ রাজধানী ছাড়বে। অথচ আমাদের গণপরিবহনে ২২ থেকে ২৫ লাখের মতো মানুষ পাড়ি দেয়ার সক্ষমতা আছে। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের আগে ছুটি না বাড়ালে দেশের সব পথে যাতায়াত পরিস্থিতি কোমায় চলে যেতে পারে।
তাই ৮ ও ৯ এপ্রিল দুদিন দিন ঈদের ছুটি বাড়ানো হলে ৫ এপ্রিল থেকে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে, ধাপে ধাপে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ বলছে, এবারের ঈদে ঢাকা থেকে ১ কোটি, গাজীপুর থেকে ৪০ লাখ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ১২ লাখসহ ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করবে।
এসব যাত্রীর মধ্যে ঈদের আগের চারদিনে বাস-মিনিবাসে ৩০ লাখ, ট্রেনে ৪ লাখ, প্রাইভেট কার, জিপ ও মাইক্রোবাসে ৩৫ লাখ, মোটর সাইকেলে ১২ লাখ, লঞ্চে ৬০ লাখ, উড়োজাহাজে প্রায় এক লাখ যাত্রীর যাতায়াত হতে পারে।