মূল্যস্ফীতির চাপে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মানুষ, ব্যয়ের চাপে দিশাহারা
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: মূল্যস্ফীতির চাপে সঞ্চয় ভেদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারাবাহিক চাপে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের ভোগান্তি আরও বেশি। বাজারে গিয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না তারা। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে তাই এতদিনের জমানো সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন অনেকেই। এ কারণে নতুন সঞ্চয়ের প্রবণতাও কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সরকারি সঞ্চয়পত্রের লেনদেনে। নতুন কেনার চেয়ে বেড়ে গেছে ভাঙানোর প্রবণতা।
একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র কেনার দীর্ঘ লাইন দেখা গেলেও বর্তমানে তা আর নেই। এর পরিবর্তে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর জন্যই বেশি মানুষ আসে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে দেখা যায়, কেউ কেউ মেয়াদপূর্তির আগেই সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে এসেছেন। আবার কেউ কেউ এসেছেন মেয়াদপূর্তির পরে ভাঙাতে। আর কেউ এসেছেন সঞ্চয়পত্রের মাসিক বা ত্রৈমাসিক সুদ নিতে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইয়াসমিন বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী বেঁচে নেই। তার পেনশনের পুরো টাকা সঞ্চয়পত্র করে রেখেছিলাম। তা দিয়েই চার ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার চলছিল; কিন্তু এখন আর তা দিয়ে সংসার চলে না। কারণ বর্তমানে সব জিনিসের দামই অনেক বেশি। তাই সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর বিষয়ে জানতে এসেছি। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ভাঙাতে গেলে অনেক কম টাকা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে ব্যাংক।’
তার মতো অবস্থা অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের। তারা নতুন করে সঞ্চয় করার পরিবর্তে আগে করা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। সঞ্চয় ভেঙে সংসার খরচ সামলাতে হচ্ছে বলে সঞ্চয়ের স্থিতি কমে যাচ্ছে। এমনি করে নতুন সঞ্চয়ের গতিও কমে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঞ্চয়ের স্থিতিও কমেছে।
এদিকে কোরবানির ঈদের বাকি আরও প্রায় এক মাস। নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফিরছে না। বরং দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এতে চাপে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সরবরাহে খুব একটা ঘাটতি না থাকলেও বেশির ভাগ পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ ছাড়া অস্থিরতা তৈরি হয়েছে ডিম ও মাংসের বাজারেও। গতকাল শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যের এসব চিত্র দেখা গেছে।
বাজারে দেখা যায়, ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২২০-২৩০ টাকা। যা কয়েক সপ্তাহ ধরে একই দামে বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়াও সোনালি পাকিস্তান জাতের মুরগি ৩৮০-৪০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। লেয়ার মুরগি লাল ৩৫০-৩৭০, সাদা ২৮০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকার উপরে।
মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, ২০০ টাকার নিচে তেমন কোনো মাছ নেই। সাইজ ভেদে তেলাপিয়া ২২০-২৫০ ও পাঙাশ ২১০ থেকে ২৪০ টাকা। যা গত সপ্তাহেও প্রায় একই দামে বিক্রি হয়েছে। অন্য মাছের মধ্যে মাঝারি ও বড় আকারের চাষের রুই, কাতলা ও মৃগেল মাছের দাম প্রতি কেজি ২৮০ থেকে শুরু করে সাইজভেদে ৪০০-৪৫০ টাকা। ৬০০ টাকার নিচে নেই পাবদা, টেংরা, কই, বোয়াল, চিতল, আইড় ও ইলিশ মাছ। চাষের কই বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩০০, চাষের শিং মাছ ৩৫০-৪৫০ টাকায়।
মাছ বিক্রেতা খালেক বলেন, একমাস আগের চেয়ে মাছ কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। এতে আমাদের বেচাকেনা কমেছে। ব্যবসা করা কঠিন হয়ে গেছে। আড়তে মাছ নাই। যা পাই চড়া দাম। কাস্টমার নিচ্ছে না। রামপুরার হাজিপাড়া বউবাজারে আসা গৃহকর্মী ফাতেমা খাতুন বলেন, বাচ্চাকাচ্চাকে মাছ-মাংস খাওয়াতে পারি না। ঝোলভাত খাওয়ার জেদ করলে এক হালি ডিম কিনে রান্না করে দিলে খুশি হতো। এখন সেটাও কিনতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বউবাজারসহ রাজধানীর রামপুরা-মালিবাগ বাজারের ডিম বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ডিমের উৎপাদনে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কয়েকদিন আগেও প্রচণ্ড গরমের কারণে খামারে অনেক মুরগি মারা গেছে। ফলে বাজারে ডিমের সরবরাহ হুট করে কমে গেছে। এদিকে আবারও উত্তাপ ডিমের বাজারে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৫৫ টাকায়। হালি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৫০-৫৫ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগেও ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। গত সপ্তাহেও বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা ডজন।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার দোকানদার আল-আমীন বলেন, কয়েক দিন আগে আমি নিজেই বিক্রি করেছি ১২০ টাকা ডজন। এখন আমরা এই দামে কিনতেও পাই না। ঢাকায় ডিমের বড় দুটি পাইকারি বাজার আছে। এর একটি কারওয়ান বাজারসংলগ্ন তেজগাঁও রেলস্টেশন পাইকারি ডিমের বাজার। অন্যটি পুরান ঢাকার কাপ্তানবাজার। এই দুই বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার পাইকারিতে ১০০ বাদামি ডিম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১৮০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়।
যদিও প্রান্তিক খামারিরা ডিমের দাম কমা-বাড়া নিয়ে তেজগাঁও আড়তমালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, কিছুদিন আগে ডিমের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমিয়ে দেন আড়তমালিকরা। যে সময় সারা দেশে ডিম হিমাগারে মজুত হয়েছে। এখন দাম বাড়িয়ে তারা মুনাফা করছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, সারা দেশে মেসেজের মাধ্যমে তারা (তেজগাঁও আড়তমালিকরা) ডিমের দাম নির্ধারণ করে।
হুট করে তারা দাম কমিয়ে দিয়ে খামারিদের থেকে ডিম নিয়ে হিমাগারে সংরক্ষণ করে, এরপর আবার দাম বাড়িয়ে এ সিন্ডিকেট মুনাফা লুটছে। তিনি বলেন, ঢাকার আড়তগুলোতে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লাখ ডিম বিক্রি হলেও তারা সারা দেশে বিক্রিত চার কোটি ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে। প্রতিদিন তারা মেসেজ দিয়ে বাজারদর জানিয়ে দেয় সারা দেশে থাকা আড়তদারদের। তারা এখন ডিমের বাজারে সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেট।
এদিকে সবজির বাজারে লম্বা বেগুন প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা, গোল বেগুন ৭০-৮০ টাকা, টমেটো ৬০-৭০, করলা ৮০-৯০ টাকা, চিচিঙ্গা ৭০-৮০ টাকা, ঢেঁড়স ৪০-৫০ টাকা মান ও সাইজভেদে লাউ ৬০-৮০ টাকা, শসা ৫০-৬০, ছোট সাইজের মিষ্টি কুমড়া ১০০-১২০ টাকা, জালি ৫০-৬০ টাকা, পেঁপে ৪০-৫০, কাঁচা কলা ডজন ৯০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। যা গত সপ্তাহজুড়ে প্রায় একই দামে বিক্রি হয়েছে।
এ ছাড়াও শাকের মধ্যে পাট শাক ১৫-২০, কলমি শাক ১০-১৫, পালং ১০-১৫ টাকা, লাউ শাক ৩০-৪০, লাল শাক ১৫ টাকা, পুঁই শাক ৩০-৪০ টাকা আঁটি বিক্রি হচ্ছে। তবে বাজারে দোকানের তুলনায় ভ্যানে কিংবা ফুটপাতের দোকানগুলোতে প্রত্যেক সবজির দাম ৫-১০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে।
অপরদিকে আলু ৫০-৬০ টাকা, কাঁচামরিচ ১২০-১৪০ টাকা, আমদানির পরেও খুচরা বাজারে কমেনি পেঁয়াজের দাম।
প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭৫ টাকা, রসুন ১৮০-২০০ টাকা, আদা ২০০-২২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। তবে বাজারভেদে দাম কিছুটা কমবেশি হচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, তীব্র গরমের কারণে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থা। এতে বাজারে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়ায় দাম বাড়ছে পণ্যের। ক্রেতারা বলেন, এ বছর রোজার আগে থেকেই বেড়েছে পণ্যের দাম।
কিন্তু ঈদের পরও সেই দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চাপ বাড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের সংসারে। অসহায় ক্রেতাদের এখন চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ব্যবসায়ীরাও বুঝে গেছে, দাম বাড়ালেও পণ্য কিনবে সাধারণ মানুষ। তাই খেয়াল খুশিমতো দাম বাড়াচ্ছে পণ্যের।