ডোনাল্ড লুর সফরে বিএনপিতে হতাশা-অস্বস্তি
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ক্ষতাসীনদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে অস্বস্তিকর পরিস্থতি সৃষ্টি হয়েছিল তা ভুলে নতুন করে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে গেছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এই ঘোষণায় নির্বাচনের আগে টানা দুই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থাকা বিএনপিতে আছে হতাশা। নির্বাচনের আগে না হলেও পরবর্তী সময়ে দেশটির কাছ থেকে ইতিবাচক কিছু আশা করছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা। তা না হওয়ায় বিপরীত দিকে নতুন করে অস্বস্তি শুরু হলো এমন আলোচনা চলছে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে।
এছাড়া নির্বাচন ঘিরে বিদেশিদের তৎপরতায় অনেকটা আশাবাদী ছিল বিএনপি। নেতাকর্মীদের মধ্যেও ছিল এক ধরনের উচ্ছ্বাস। নির্বাচনের পর সেই উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়েছে। তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী খাবি খাচ্ছেন হতাশায়। তারা ধরেই নিয়েছেন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিরা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বড় কোনো উদ্যোগ নেবে না। সরকারের ওপর চাপও আসবে না।
পরিস্থিতির কোনো অগ্রগতি দেখতে না পেয়ে তৃণমূলের অনেক নেতা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। মাঠ পর্যায়ের নেতারা দলের নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা ও কূটনৈতিক অবস্থাকে দোষারোপ করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফর নিয়ে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপে এমন হতাশার চিত্র উঠে আসে। অনেকে অবশ্য হতাশার মাঝেই আশার বসতি দেখছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছর ডোনাল্ড লুর সফর বেশ আলোচনায় ছিল। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন করা বিএনপি তখন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। তবে লুর এবারের সফর ঘিরে উৎসাহ ছিল না বিএনপির। সফরে এসে অতীত ভুলে নতুন করে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে গেছেন লু। এই ঘোষণায় বিএনপিতে তৈরি হয়েছে হতাশা-অস্বস্তি। যদিও প্রকাশ্যে বিষয়টি আড়াল করছেন দায়িত্বশীল নেতারা।
ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক বলেন, কেউ কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয় না। নির্বাচনের আগেই আমরা এটা বুঝেছিলাম-পশ্চিমারা শুধু আহ্বানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আন্দোলনে নির্ভরশীলতা থাকা যাবে না। লড়াইটা আমাদেরই করতে হবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বন্ধু হিসেবে আমরা সবার সহযোগিতা কামনা করি।
বিএনপির দলটির একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির নেতারা বিদেশিদের কূটনৈতিক ভাষা বোঝেন কি না, সন্দেহ আছে। যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থের বাইরে যাবে না। ভূ-রাজনীতিতে তারা নিজেদের স্বার্থকে শতভাগ সমুন্নত রেখে কাজ করে। বিশ্ব রাজনীতি এখন পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তিত রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মো. ওবায়েদ পাঠান বলেন, দলের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে জানানো হয়েছে আগামী জুনের মধ্যেই বড় একটি পরিবর্তন আসতে পারে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এই সরকার বাজেটই ঘোষণা করতে পারবে না। আর এটা যদি না হয়, তা হলে তৃণমূল আরও ভেঙে পড়বে। ইউনিয়ন ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা এখন হতাশ। তাদের সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই।
নির্বাচন উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বিএনপির উদ্বেগের কারণ কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে দলের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য মীর মোহাম্মদ
হেলাল উদ্দিন বলেন, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বলছে বাংলাদেশের সঙ্গে তারা কাজ করছে। কিন্তু তারা এটা বলেনি এই সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী তারা এটা বলবেই। অবৈধ একটি নির্বাচন হওয়ার পর কম্বোডিয়ায় ৭৪ দিন পর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল; একইভাবে ১০৪ দিন পর সিয়েরা লিয়ন ও ১ হাজার ৬৫ দিন পর জিম্বাবুয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে এসব বিষয় কার্যকর করে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কে গণতন্ত্রের পক্ষ নেবে, কে বিপক্ষ নেবে-এখানে আসলে দলের কূটনৈতিক তৎপরতার অবদান কিংবা দুর্বলতার কিছু নেই। কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি তো আমরা নির্ধারণ করতে পারব না। আমাদের কাজ বিদেশিদের সামনে দেশের অবস্থা ও জনগণের আকাক্সক্ষার কথা তুলে ধরা। এরপর সিদ্ধান্ত তাদের।
এখন কোনো বিদেশি রাষ্ট্র যদি জনমত উপেক্ষা করে বিশেষ একটি গোষ্ঠী বা দলকে গুরুত্ব দিতে চায়, সেটি তাদের সমস্যা। এর সমাধান তো বিএনপির কূটনৈতিক উইং দিতে পারবে না। তিনি বলেন, বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি হয় না। অনেকের ধারণা-ওমুকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে, তমুকে ওটা করে দেবে। এটা খুব খারাপ সংস্কৃতি। এই নির্ভরশীলতা ভালো না।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, নির্বাচনের আগে যে কথা বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র, নির্বাচনের পরও সেই কথা বলেছে। এখন সরকার যদি ভাবে যে, মার্কিন প্রতিনিধি এসে তাদের সঙ্গে কথা বলেছে, আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, এমন ভাবলে সরকার ভুল করবে।
লুর সফরের শেষ দিনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র আগের অবস্থানেই আছে। যুক্তরাষ্ট্র একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছে। এটা তারা এখনও অব্যাহত রেখেছে। আন্দোলনের বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্র রক্ষা করতে এবং সরকার পরিবর্তনের জন্য নিজেদেরই লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এসব অন্য কেউ এসে করে দিয়ে যাবে না। এদিকে যুগপৎ শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে কয়েকটি দল বিএনপিকে বিদেশমুখিতা কমানোর পরামর্শ দেন। ভবিষ্যৎ আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর তাগিদ দেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, নির্বাচনের আগের অবস্থান ও বক্তব্যের সঙ্গে পরের বক্তব্য এক হবে-এটা আশা করা ঠিক হবে না। ভূ-রাজনীতি পররাষ্ট্র নীতি ওঠানামা করে। ডোনাল্ড লুর সফরের প্রভাব বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। বিএনপি আগে কতটা প্রত্যাশা করেছে, এখন কেন কমে গেল, এটা তাদের কৌশলগত ব্যাপার হতে পারে।