মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিকভাবে দরপতন হচ্ছে। টানা দরপতনের মধ্যে পড়ে প্রতিদিন বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। লোকসান কাটিয়ে ওঠার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। ফলে দিন যত যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর আতঙ্ক তত বাড়ছে। আতঙ্কে অনেকেই দিনের সর্বনিম্ন দামে শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করছেন। ফলে মাত্রাতিরিক্ত বিক্রির চাপে বাজারে ক্রেতা সংকট দেখা যাচ্ছে। এতে সূচকের যেমন পতন হচ্ছে, তেমনি কমে আসছে লেনদেনের গতি। এটি সঠিক কাজ নয়।

ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি বুঝে বিনিয়োগ করা উচিত বলে মন্তব্য করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল ও গতিশীল রাখতে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারের বিকল্প নেই। দীর্ঘদিন ধরে ভালো মৌল ভিক্তি শেয়ারে দর না বাড়ায় বাজারের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বিনিয়োগকারীরা। এখনই ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারের ভর করে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতো বলে মন্তব্য করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রধান উৎস পুঁজিবাজার হলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশের মোট অর্থায়নের মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়নের তথ্যে তা খুব ভালো করেই উপলব্ধি করা যায়। যেখানে ৯৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ অর্থায়ন এসেছে ব্যাংক থেকে। দেশের পুঁজিবাজারের যাত্রা ছয় দশকের বেশি। কিন্তু অর্থনীতির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের পুঁজিবাজার এগোতে পারেনি। এর পেছনে অবশ্য বেশকিছু কারণ রয়েছে। পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি, ৮০ শতাংশের ওপরে।

এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফেরাতে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারের দর বাড়া উচিত। কারণ দীর্ঘ সময় পুঁজিবাজার টানা দরপতনে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ার একবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। বিনিয়োগকারীরা যদি ভালো কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করেন তবে তারা সাধারণত ভালো মুনাফা করতে পারেন। ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের লাভবান করে। পাশাপাশি তাদের শেয়ারদামও ঊর্ধ্বমূখী থাকে। কিন্তু গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়।

গত অর্থবছরে অন্তত ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগকারীরা চলতি বছরের গত প্রথম চার মাসে লোকসানে পড়েছেন। অন্যদিকে, যারা ১৫ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার নিয়ে বাজি ধরছেন, তাদের পকেট ভারী হয়েছে। গত চার মাসে ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত ইউনাইটেড পাওয়ার, ওয়ালটন, এসিআই, রেনাটা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলসের শেয়ারের দাম ৩০ শতাংশের বেশি কমেছে। গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম কমেছে ১৭ শতাংশ।

অথচ একই সময়ে কম মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশ মনোসপুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং, তৌফিকা ফুডস ও লাভেলো আইসক্রিম, পেপার প্রসেসিং, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ও বিচ হ্যাচারির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি।

গত অর্থবছরে ৮০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া ব্লু-চিপ প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশনের শেয়ারের দাম গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে কমেছে ৪৭ শতাংশ। দেশের শীর্ষ ইলেকট্রনিক্স পণ্য প্রস্তুতকারক ওয়ালটন ৩০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিলেও এর শেয়ারের দাম কমেছে ৪২ শতাংশ। কয়েকটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের মালিকানাধীন ও ৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান এসিআইয়ের শেয়ারের দাম ৪৬ শতাংশ কমেছে।

দেশের অন্যতম শীর্ষ ওষুধ প্রতিষ্ঠান রেনাটা গত অর্থবছরে সাড়ে ৬২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিলেও এর শেয়ারে দাম কমেছে ৩৭ শতাংশ।
শীর্ষ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ারের দাম কমেছে ৩০ শতাংশ। গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি শতভাগ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। সব মিলিয়ে জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ব্লু-চিপ শেয়ারের সূচক আট শতাংশ কমে এক হাজার ৯৯৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে, ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া স্বল্প পরিশোধিত মূলধন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মনোসপুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের শেয়ারের দাম গত চার মাসে ১২৬ শতাংশ বেড়ে পুঁজিবাজারে শীর্ষে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল তৌফিকা ফুডস ও লাভেলো আইসক্রিম পিএলসি। এর শেয়ারের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। পেপার প্রসেসিং ও প্যাকেজিংও দ্বিগুণ হয়েছে। গত অর্থবছরে লাভেলো ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছিল। এর ১২ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দেওয়ার রেকর্ড ছিল না। আগের বছর পেপার প্রসেসিং ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারের গতি ফেরাতে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারের বিকল্প নেই। কারণ পুঁজিবাজারে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারে বিনিয়োগ করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। এখন সময় এসেছে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারে ভর করে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর।

কারণ গত দুই বছর ধরে পুঁজিবাজার ক্যাসিনোর মতো আচরণ করেছে। দুর্বল শেয়ারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। সুস্থ বাজারে এটা সম্ভব নয়। পুঁজিবাজারের আচরণ অস্বাভাবিক। যেসব শেয়ারকে নিয়ে কারসাজির সুযোগ আছে বিনিয়োগকারীরা সেগুলোর পেছনে ছুটছেন। যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে মুনাফা ও লেনদেনের তালিকার শীর্ষে থাকে সেগুলো এখন ধুঁকছে। তার মতে, শুধু কারসাজিই নিম্নমানের শেয়ারের দাম উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কারসাজির বিষয়ে অন্ধের মতো আচরণ করছে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, খারাপ শেয়ারের দাম বেড়ে যাওয়া ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসহ ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কমে যাওয়াকে পুঁজিবাজারে সুশাসনের অভাব বলে মনে করছেন। কারণ যখন আন্ডারপারফর্মিং প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তখন নিয়ন্ত্রকদের হস্তক্ষেপ করা উচিত। এর জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। শুধু বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নয়, স্টক এক্সচেঞ্জগুলোরও নজরদারির সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষ এক ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান পুঁজিবাজারে তারল্যেও চেয়ে আস্থা সংকট বেশি। আস্থার সংকট ফিরিয়ে আনতে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারের দাম বাড়াতে হবে। কারণ দীর্ঘ পতনে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ার তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ অবস্থায় বাজার ঘুরে দাঁড়াতে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারের বিকল্প নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।