দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় আমানতের টাকা তুলতে না পেরে গ্রাহকরা ভিড় করছে প্রধান কার্যালয়ে। ছোট অংকের আমানতও পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকটি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, একসঙ্গে বড় অংকের আমানত তুলে নেওয়ায় চাপে পরেছে ব্যাংক। পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্পদ বিক্রি করে তারল্য বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

ফলে লুটপাটে কাবু আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবার আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ভেঙে পড়েছে ঋণ-আমানত শৃঙ্খলাও। ৮৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে দীর্ঘদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও এবার চরম তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকের চাপ নিতে পারছে না ব্যাংকটি।

সরেজমিনে দেখা যায়, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখার পাশেই এটিএমবুথ। সেখানে নেই কোন নগদ টাকা। জানা যায়, কয়েকমাস ধরে এমন পরিস্থিতি। অল্পকিছু টাকার জন্য ব্যাংকের শাখায় ঘুরছেন গ্রাহকরা। ফলে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক গ্রাহকের ১ হাজার টাকা ১৫ দিনেও দিতে পারছে না। মূলত তারল্য সংকট থাকার কারণে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে ব্যাংকটি।

এছাড়া প্রায় এক মাস ধরে ১০ হাজার টাকা উত্তোলনের জন্য একাধিকবার ব্যাংকে গেলেও টাকা পাচ্ছেন না গ্রাহক। শুধু দুজন গ্রাহক নন। এমন বহু গ্রাহক দিনের পর দিন তাদের টাকা তোলার জন্য আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে আসছেন। কিন্তু তাদের টাকা ব্যাংক দিতে পারছে না। সরেজমিনে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মতিঝিল প্রিন্সিপাল শাখায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিলে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ব্যাংকের ম্যানেজার উপস্থিত নেই। এছাড়া বেশিরভাগ কর্মকর্তা কর্মচারীর আসন ফাঁকা পরে থাকতে দেখা যায়। ব্যাংকে উপস্থিত একজন ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমাদের ব্যাংকের ম্যানেজার মিটিংয়ে গেছেন।

তবে অন্য কর্মকর্তারা কোথায় এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। সকাল থেকে ব্যাংকে ম্যানেজারের জন্য অপেক্ষারত ব্যাংকের গ্রাহক শাহিনুর এবং কাদের মোল্লা। তারা দুজনই বেশ কয়েকদিন ধরে ব্যাংকে আসছেন তাদের টাকা তুলতে। কিন্তু ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। তাই তারা ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন।

ব্যাংকটির গ্রাহক শাহিনুর বলেন, ‘আমি ১ হাজার টাকা উঠাবো ব্যাংক থেকে কিন্তু এটা পারছি না। ব্যাংক আমাকে টাকা দিতে পারছে না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন ব্যাংকে না-কি টাকা নাই। আমরা ম্যানেজারের জন্য অপেক্ষা করছি কিন্তু সকাল থেকে তার কোনো খোঁজ নেই।’কতদিন ধরে ১ হাজার টাকা তোলার জন্য আসছেন এমন প্রশ্নের জবাবে এ গ্রাহক বলেন, ‘আমি ১৫ দিন ধরে আসছি কিন্তু তারা কোনো টাকা দিতে পারছে না।

আমার সহকর্মী কাদের মোল্লা ভাই ১০ হাজার টাকার জন্য প্রায় এক মাস সময় ধরে ব্যাংকে আসছেন কিন্তু তিনি টাকা পাচ্ছেন না। ব্যাংকে নাকি টাকা নাই।’ এক মাসে তিনবার এসেও টাকা পাননি ইতালি প্রবাসী আফসার উদ্দিন নামের একজন গ্রাহক। আফসার বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করছি। এর আগে আমি কুয়েতে থাকতাম, বর্তমানে ইতালিতে থাকি। এই ব্যাংকে আমার একাউন্টে প্রায় ৮ লাখ টাকা রয়েছে। গত এক মাসের মধ্যে ৩ বার এসেছি, তবে এখনো টাকা পাইনি।

ব্যাংক থেকে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘টাকা পাবো এরকমটাই বলা হচ্ছে ব্যাংক থেকে। ব্যাংকে ঝামেলা চলতেছে বলেও কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন আমাকে। আবার প্রধান কার্যালয়েও যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। আমি যতবার এসেছি কখনো এই শাখার ম্যানেজারকে পাইনি। যখনই আসি তখনই বলা হয়, ম্যানেজার বাইরে চলে গেছে।’

আরেকজন গ্রাহক শিবলী মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘এই ব্যাংকে দুই বছর আগে ৩ লাখ টাকা রেখেছিলাম। হঠাৎ করে শুনতেছি ব্যাংকটি গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। তাই আমি গত ১৫ দিন আগে এসেছিলাম টাকা তুলতে। ব্যাংক থেকে বলা হয়েছিলো কয়েকদিন পরে আসার জন্য। এরপর আজকে আবার এসেছি। তবে ব্যাংকটির এই শাখা থেকে টাকা দিতে পারছে না, তারা শুধু আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে টাকা দিয়ে দিবে।’

এ বিষয়ে জানতে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহকে ফোন করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। এরপর ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি সচিব রাবেবুল আলম উজ্জলকে ফোন দেয়া হলে তিনিও তা রিসিভ করেননি।

২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে ওঠা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটি বছরের শুরু থেকে তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে। তাই পুরোদমে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৭৯০ কোটি ৪ লাখ টাকা বিতরণ করা ঋণের (বিনিয়োগ) ৮৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে জানা গেছে, ব্যাংকটির পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক যে, তাদের এমন কোনো সিকিউরিটিজ নেই, যার বিপরীতে অন্য ইসলামী ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে পারবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শিগগিরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় একটি শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ জমে থাকা আমানত, মূলধন ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকটে ব্যাংকটি এখন পদ্ধতিগত ঝুঁকিতে রয়েছে।’

আর্থিক সংকট নিরসনে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতহীন ৫০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তার আবেদন করেছিল আইসিবি ইসলামি ব্যাংক। তবে দুই সপ্তাহ পর সেই আবেদন খারিজ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ আগে থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৪২৫ কোটি টাকা দায় ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘আমরা ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত আছি। ব্যাংকের তহবিলের একটি বড় অংশ কিছু লিজিং কোম্পানির কাছে আটকে আছে, যার কারণে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।’

পুঁজিবাজারেও নাজুক পরিস্থিতি: শরিয়াহভিত্তিক এই ব্যাংকটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৯০ সালে। ব্যাংকটির শেয়ারদর বর্তমানে ফেস ভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে। ৩ টাকা ৭০ পয়সায় এসে দাঁড়িয়েছে শেয়ারদর। ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি আয়ও লোকসান কাটাতে পারেনি ২০১৮ থেকে। ২০১৮ সালে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৭৩ পয়সা। এরপরের বছর ২০১৯ সালে লোকসান হয় ৬৪ পয়সা। ২০২০ সালে লোকসান হয় ২৮ পয়সা। ২০২১ সালে লোকসান দাঁড়ায় ৫৯ পয়সা।

২০২২ সালে লোকসান দাঁড়ায় ৩৮ পয়সায়। এতে দেখা যায়, ব্যাংকটি এই লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতেও ব্যর্থ। সর্বশেষ ২০২৩ হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি ব্যাংকটি। ১ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা রিজার্ভ সংকটে রয়েছে ব্যাংকটি। ব্যাংকটির অনুমোদিত মূলধন ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ৬৬৪ কোটি টাকা।

ব্যাংকের মোট শেয়ারের ৫২ দশমিক ৭৬ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, সরকারের হাতে রয়েছে দশমিক ১৭ শতাংশ আর বাকি ২৫ দশমিক ৪২ শতাংশ রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োজিত পর্যবেক্ষক থাকা সত্ত্বেও আর্থিক অবস্থার এই দশা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মো. রজব আলীকে ২০২২ সালে পর্যবেক্ষক হিসেবে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু, পূর্বসূরিদের মতো তিনিও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হন।

জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটি লোকসানে আছে এবং ২০২৩ সালে লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এমনকি লোকসানের কারণে দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ফ্রোজেন ডিপোজিট ছিল ৪৪৪ কোটি টাকা।

ফ্রোজেন ডিপোজিট হল ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানত, যা মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটকে রেখেছিল। ব্যাংকটির ফ্রোজেন ডিপোজিট ছিল ২ হাজার কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানতকারীদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

ব্যাংকটির উৎপত্তি ১৯৮৭ সালে, তখন এটি আল-বারাকা ব্যাংক নামে পরিচালিত হতো। ১৯৯৪ সালে এটি ‘সমস্যাযুক্ত ব্যাংকে’ পরিণত হয়। তখন ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ত্রুটিযুক্ত ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রথা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০০৪ সালে এটি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে।

তবে ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ার পর ২০০৬ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে দেয়। ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে আনুমানিক ৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে ৩৪টি মামলা হয়েছিল।

তখন বাংলাদেশ ব্যাংক এটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষার জন্য ব্যাংকের প্রশাসক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালককে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০৭ সালের আগস্টে ব্যাংকটির অধিকাংশ শেয়ার বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনাকারী সুইস আইসিবি গ্রুপের সঙ্গে দরপত্রে অংশ নেন দুজন দরদাতা। ২০০৮ সালে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মতোই নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় চলছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও বেড়েছে অনেক। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। ফলে বাড়ছে নানারকম জালজালিয়াতি, অর্থ পাচার ও আত্মসাতের মতো ঘটনা। এতে নাজুক অবস্থায় পড়েছে পুরো আর্থিক খাত। এ অবস্থা থেকে ফেরাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করে সুশাসন নিশ্চিত জরুরি। পাশাপাশি ঋণ কেলেঙ্কারির নেপথ্য নায়কদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

এ বিষয় জানতে চাইলে বিআইবিএম-এর সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আজকের পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই দায়ী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুলনীতির কারণে ব্যাংকটির সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। যখন লুটপাটের শিকার হয়, তখন ব্যাংকটিকে অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে খারাপ অবস্থায় আবার ব্যাংকটিকে বিক্রি করে দেয় মালয়েশিয়ান কোম্পানির কাছে। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।