দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের আর্থিক খাতের জালিয়াত হিসেবে পরিচিত প্রশান্ত কুমার হালদারকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটে সহায়তাকারী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক বিতর্কিত নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম হঠাৎ করেই গত সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসেছিলেন। এসময় তিনি ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) খুরশিদ আলমের সাথে রুদ্ধধার বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে। ডিজি খুরশিদ আলম বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত ডিজি।

আর পিকে হালদারের অর্থ লোপাটের সময় শাহ আলম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। ঘুষের বিনিময়ে পিকে হালদারকে সুবিধা দেয়ার অভিযোগ উঠার পরই ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

জানা গেছে, হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত কারণ উদঘাটন (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং) কমিটিও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা অনিয়মে শাহ আলমের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন। এছাড়া দুদকের জেরার মুখেও পড়েছেন শাহ আলম। এমনকি তার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এসব কারণে অবসরের পর আর তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকে দেখা যায়নি।

কিন্তু সেই বিতর্কিত নিবাহী পরিচালক (ইডি) শাহ আলম হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত ডিজি খুরশিদ আলমের সাথে রুদ্ধদার বৈঠক করার খবরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জুড়ে তৈরি হয়েছে চাঞ্চল্য। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ঋণ খেলাপি, জালিয়াত ও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সোমবার দুপুরের দিকে ইডি শাহ আলম বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত হন। পরে

তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ভবনের চতুর্থ তলায় অবস্থিত ডেপুটি গভর্নর-৩ খুরশিদ আলমের রুমে উপস্থিত হন। এরপর চলে প্রায় দেড় ঘন্টার রুদ্ধদার বৈঠক। যদিও ওই সময়ে দুইজনের মধ্যে কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা জানা যায়নি।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের জন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কিনা সে বিষয়েও কিছু জানা যায়নি। তবে বিতর্কিত এই সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডাকা হয়নি। আমি ব্যক্তিগত কাজে গিয়েছিলাম।

এর আগে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেই লুটপাট চালিয়েছে ওই সময় সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা। এমনকি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক কর্মকান্ড, নিয়ম-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩ এর বিভিন্ন ধারায় স্পষ্ট বর্ণনা আছে।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইচ্ছামতো স্বাধীনতা ও একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়ে ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ছয়টি সার্কুলার জারি করে, যা ছিল সম্পূর্ণ আইনের উদ্দেশ্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ১৮ ধারার পরিপন্থী এবং এখতিয়ারবহির্ভূত। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বেআইনি ও নজিরবিহীন উদারতাই পিপলস লিজিংসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়ন্ত্রণহীন অবৈধ কর্মকান্ড পরিচালনা ও আর্থিক খাতে উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আসল শক্তি বলে মনে করে তদন্ত কমিটি। এসব সার্কুলার ব্যবহার করেই ব্যাংক আমানত থেকেও বেশি সুদের লোভ দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ করে মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে এবং লুটপাট করেছে।

তথ্য বলছে, ওই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ও নির্বাহী পরিচালকসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়ি করা হয়েছে। দায়ীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ভূমিকায় শাহ আলমের নাম আসায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ অন্তত পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এসব অর্থ লোপাটের তথ্য চাপা দিতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম। এসব অনিয়মের সহায়তা করতো সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। বিনিময়ে পেত আর্থিক সুবিধা। ঘুষের বিনিময়ে এসব অনিয়মে সহায়তা করেছেন আরোও বেশকিছু কর্মকর্তা।

পিকে হালদারের অন্যতম সহযোগী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হকের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাশেদুল হক। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে আনে।

রাশেদুল হক জবানবন্দিতে আদালতে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে দিত রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে প্রতি মাসে দেওয়া হতো দুই লাখ টাকা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।

ইডি শাহ আলমের নানা অনিয়মের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন অনিয়ম দুর্নীতিতে অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরাও। তাদের অভিযোগ পিপলস লিজিংয়ের বর্তমান পরিচালকদের যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও বর্তমান ইডি শাহ আলমের জড়িত।

প্রায় দেড় বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রধান বিচারপতি, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সরকারের সংশ্লিষ্ট ১১টি প্রতিষ্ঠানে লিখিত আকারে এ অভিযোগ দেয়া হয়। ২০১৯ সালের ২৮ জুলাইয়ে দেয়া উল্লিখিত লিখিত অভিযোগে স্বাক্ষর করেন ৭৬ জন আমানত ও বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারা।