চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির নতুন কমিটিতে থাকছে চমক
দেশ প্রতিক্ষণ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করায় পূর্ণাঙ্গ কমিটির আসায় চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। নগর কমিটির দায়িত্বে কারা আসছেন তা নিয়ে তৃণমূল থেকে নীতিনির্ধারণী ফোরামে চলছে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ। প্রায় ১৫ বছর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা ডা. শাহাদাত হোসেন কি দলের নেতৃত্বে থাকছেন, নাকি নতুন মুখ আসছে। পাশাপাশি বিলুপ্ত কমিটির সদস্যসচিব আবুল হাশেম বক্করকে কিভাবে মূল্যায়ন করা হতে পারে সে আলোচনাই এখন তুঙ্গে। রাজপথে আন্দোলনের গতি ফেরাতে এবার নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে কমিটিতে চমক আসছে বলে অনেকের ধারণা।
হঠাৎ করে আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে দেওয়ায় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ধারণা নতুনরূপে সাজানো হবে নগর কমিটি। আবার কেউ কেউ বলছেন, ডা. শাহাদাত হোসেনকে সভাপতি রেখে নতুন কাউকে সাধারণ সম্পাদক করা হবে। কারও কারও অভিমত, ডা. শাহাদাত হোসেন ও আবুল হাশেম বক্করের কোনো বিকল্প নেই। দলের তৃণমূল কর্মীদের প্রত্যাশা, বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের হাতেই নেতৃত্ব আসুক, যারা হবেন কর্মীবান্ধব। নতুন কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়নে হাইকমান্ডের দিকে তাকিয়ে আছে তারা।
ডা. শাহাদাত হোসেন আর আবুল হাশেম বক্করের নেতৃত্বে বিগত দিনে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি ঐক্যবদ্ধ ছিল। একসময় নগর বিএনপিতে ‘যত নেতা, তত গ্রম্নপে’র যে বদনাম ছিল তা এখন নেই। দলীয় ঐক্য অটুট রেখেই দায়িত্ব পালন করেছেন আহ্বায়ক কমিটির নেতারা। এরপরও কোনো কোনো নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের গুডবুক থেকে সরে গেছেন বলে জানা গেছে।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নগরীর নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে একটি পক্ষ তৎপর হয়েছেন। তাদের তৎপরতা সফল হলে সামনে যে কমিটি হবে তাতে নতুন মুখ আসতে পারে, আবার বাদ পড়তে পারেন বিলুপ্ত কমিটির অনেকে। নতুন কমিটিতে আসতে নেতাদের অনেকে তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে তাদের অনুসারীদের ভালো পদে বসাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন বলে মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
এদিকে বেশ কয়েক বছর ধরেই সভাপতি হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন বিলুপ্ত কমিটির সদস্য ব্যবসায়ী এরশাদ উলস্নাহ। ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে বিএনপি প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেছিলেন। সম্ভাব্য সাধারণ সম্পাদকের পদে আলোচনায় আছেন বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক নাজিমুর রহমান, এসএম সাইফুল আলম, বিলুপ্ত কমিটির সদস্য ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মনজুর আলম মঞ্জু। এ ছাড়া সদস্য আহমেদুল আলম চৌধুরী রাসেল এবং নগর যুবদলের সভাপতি মোশাররফ হোসেন দিপ্তির নাম আলোচনায় আছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এরশাদ উলস্নাহ এবং নাজিমুর রহমানের সঙ্গে সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান নগর বিএনপির নানা বিষয় নিয়ে অনলাইনে আলোচনা করেন। ফলে তাদের অনুসারীরা বেশ আশাবাদী। তবে সার্বিক বিবেচনায় প্রায় ১৫ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে থাকা সদ্য সাবেক আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনকে সভাপতি করে নাজিমুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিতে পারেন। সে হিসেবে সদস্যসচিব আবুল হাশেম বক্করকে কেন্দ্রীয় বিএনপির কোনো পদ দিতে পারেন। অথবা ডা. শাহাদাত হোসেনকে কেন্দ্রীয় কোনো পদ দিয়ে আবুল হাশেম বক্করকেও সভাপতি করা হতে পারে। আবার নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বলছে, সব শ্রেণির নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত ডা. শাহাদাত হোসেনকে সভাপতি এবং আবুল হাশেম বক্করকে সাধারণ সম্পাদক রেখে নতুনরূপে সাজানো হবে বিএনপি’র চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি।
এ ব্যাপারে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘কেন্দ্র যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে হিসেবে আহ্বায়ক কমিটি বাতিল করা হয়েছে। বিগত সময়ে আমরা আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলাম। দলীয় সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্র নতুন কমিটি ঘোষণা করবে। নতুন কমিটি হয়তো আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে পারবে এবং কর্মীবান্ধব হবে।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমানে কেবল নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক বিষয় দেখলেই হয় না। অধিকাংশ নেতাকর্মী হামলা-মামলার শিকার; তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সামগ্রিক বিষয় নিয়েও চিন্তা করতে হবে।
আবুল হাশেম বক্কর বলেন, দলের হাইকমান্ড যেটা ভালো মনে করেছেন সেটা করেছেন। একই সঙ্গে যাদের উপযুক্ত মনে করবেন তাদের নেতৃত্বে আনবেন। ২০২০ সালে ২৩ ডিসেম্বর ডা. শাহাদাত হোসেনকে আহ্বায়ক ও আবুল হাশেম বক্করকে সদস্যসচিব করে ৩৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এর আগে ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট ডা. শাহাদাতকে সভাপতি ও আবুল হাশেম বক্করকে সাধারণ সম্পাদক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ জুলাই ২৭৫ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সভাপতি এবং ডা. শাহাদাত হোসেন নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এরশাদ উলস্নাহ বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর ধরে দলের সঙ্গে আছি। দলের নীতিনির্ধারকরা যেটা ভালো মনে করবেন, সেটাই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে ত্যাগী, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় এবং অতীতে দলের জন্য ভালো ভূমিকা রেখেছে এমন নেতৃত্ব দলকে এগিয়ে নিতে পারবে। অনেকেই আছেন দক্ষ সংগঠক, কিন্তু বড় পরিসরে দায়িত্ব পাননি। তারা কাজ করার সুযোগ পেলে দল এগিয়ে যাবে। সর্বোপরি কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটা মেনেই সবাইকে কাজ করতে হবে।’
নাজিমুর রহমান বলেন, তৃণমূলের প্রত্যাশা হচ্ছে দলের জন্য ত্যাগী এবং যোগ্যরা নেতৃত্বে আসুক। এমন নেতৃত্ব আসা উচিত যারা ছোট-বড় সবাইকে নিয়ে সংগঠনের জন্য কাজ করবেন, যাতে দল উপকৃত হয়। অবশ্যই ভালো এবং সাংগঠনিক লোক প্রয়োজন। তবে দলের হাইকমান্ড যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই চূড়ান্ত।
দলীয় সূত্র জানায়, নিষ্ক্রিয়, ব্যর্থ ও প্রবীণদের সরিয়ে তরুণদের দলের গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যার অংশ হিসেবে আন্দোলন থেকে পালিয়ে থাকা নেতাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে আন্দোলনে ভূমিকা রাখা নেতাদের দেওয়া হচ্ছে ‘উপহার’। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগর বিএনপির আন্দোলন নিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান কিছুটা ক্ষুব্ধ। সে কারণেই কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত। যে কোনো মুহূর্তে নতুন কমিটি ঘোষণা হতে পারে।
এক্ষেত্রে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ফলে চট্টগ্রামের কমিটি গঠন নিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। এদিকে চট্টগ্রাম থেকে নতুনভাবে কেন্দ্রীয় কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পদক পদে জায়গা করে নিয়েছেন সাবেক মেয়র মীর নাছিরের ছেলে ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন।
এছাড়া ১৮ সদস্যের স্পেশাল অ্যাসিটেন্ট টু দ্য চেয়ারপারসন ফরেন অ্যাফায়ার্স অ্যাডভাইজারি কমিটিতে রাখা হয়েছে মীর নাছিরের পুত্র মীর হেলালকে। এই কমিটিতে আরও আছেন বিএনপি নেতা আমীর খসরুর পুত্র ইসরাফিল খসরু। ১১ সদস্যের চেয়ারপারসন ফরেন অ্যাফায়ার্স অ্যাডভাইজারি কমিটতে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে আছেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ১৩ জুন ভেঙে দেওয়া হয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ কমিটি।