বিএনপি’র সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর নানা পরিকল্পনা
শহিদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সরকারবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সাংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। কেন্দ্রে থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে দল এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে সক্রিয় করাই দলটির মূল লক্ষ্য। কারণ সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে বার বার ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। এ ব্যর্থতা ইস্যুতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে দলটি। আন্দোলনে যে সব নেতা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ এবং অনুপস্থিত ছিলেন তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে।
এরই অংশ হিসেবে একদিনেই ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, বরিশাল মহানগরসহ একসঙ্গে মোট ৯টি কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এখন সক্রিয় নেতাদের নিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হবে। ঢাকা মহানগরসহ যুবদলের নতুন কমিটি শিগগিরই ঘোষণা আসতে পারে। এছাড়া অন্য কমিটিগুলোও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় আসবে বলে দলটির একটি সূত্র জানিয়েছে। মূলত সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতেই এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে বলে দলের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকেই চূড়ান্ত আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়া নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে বিএনপি। বিগত আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ঢাকা মহানগরসহ বেশ কিছু সংগঠন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে আন্দোলন-সংগ্রামের ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে খ্যাত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও যুবদল। এ দুটি সংগঠনের ভূমিকা নিয়েও ছিল ব্যাপক আলোচনা। গত ১ মার্চ ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে সাত সদস্যের কমিটি দেয়া হয়।
যা গত ১৫ জুন ২৬০ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এক রাতের মধ্যে ৯টি কমিটি বিলুপ্ত করার পাশাপাশি ঘটেছে দলের গুরুত্বপূর্ণ ৪৫ পদে রদবদল। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা কমিটি পুনর্বিন্যাসকে চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে দেখলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই রদবদল-সরকার পতন আন্দোলনে নেতাদের ব্যর্থতা এবং নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তাই মূল কারণ।
তবে এ রদবদল যোগ্যদের মূল্যায়নের পাশাপাশি আগামী আন্দোলন-কর্মসূচিতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছেন বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা। বাদ পড়া নেতাদের অনেকে অসন্তুষ্ট, কেউ কেউ হতবাকও।
সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশ মুখে অবস্থান কর্মসূচি সফল না হওয়ায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নগর কমিটিগুলো দলের মধ্যে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে এসব নিয়ে তখনই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এর কয়েক দিনের মধ্যেই ছাত্রদল সভাপতির পদ থেকে কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে ‘অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে’ সরিয়ে দেয়া হয়। যা দলের মধ্যে তোলপাড় তৈরি করেছিল।
এরপর ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে ডাকা মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার ঘটনাতেও এই নেতাদের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হয়। আন্দোলনে যে নেতা ও কমিটি নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, কর্মসূচিতে অনুপস্থিত ছিলেন, বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর সে সব কমিটি ও নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছে দলটির হাইকমান্ড। গত ১৩ জুন মধ্যরাতে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণসহ চারটি মহানগরে বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। অন্য দুটি কমিটি হলো চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর কমিটি। একই সঙ্গে বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর ও বরিশাল মহানগর আহ্বায়ক কমিটিও বিলুপ্তি করা হয়েছে। পাশাপাশি সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু এবং মোনায়েম মুন্নার নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়েছে। নেতাদের অনেকে মনে করেন, আন্দোলনে ব্যর্থতা ও সংগঠন গতিশীল করতে না পারায় কমিটিগুলোর নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ দলের শীর্ষ নেতা। বলা যায়, এক ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
২০২১ সালের ২ আগস্ট ঢাকা মহানগর উত্তরে আমান উল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক ও আমিনুল হককে সদস্য সচিব এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণে আব্দুস সালামকে আহ্বায়ক ও রফিকুল আলম মজনুকে সদস্য সচিব করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের কিছুদিন পর থেকে উত্তরে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছিলেন প্রফেসর ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার। ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর ডা. শাহাদাত হোসেনকে আহ্বায়ক ও আবুল হাশেম বক্করকে সদস্য সচিব করে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির ৩৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি মনিরুজ্জামান খান ফারুককে আহ্বায়ক ও অ্যাডভোকেট মীর জাহিদুল কবির জাহিদকে সদস্য সচিব করে ৪৭ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সভাপতি ও আব্দুল মোনায়েম মুন্নাকে সাধারণ সম্পাদক করে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয় ২০২২ সালের ২৭ মে। ছাত্রদলের অপর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান হয়, সংগঠনটির ঢাকা মহানগর উত্তর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, ঢাকা মহানগর পূর্ব ও ঢাকা মহানগর পশ্চিম শাখা ছাত্রদলের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
শিগগিরই নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার পতনের আন্দোলনে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। দলটির এসব কর্মসূচি বরাবরের মতো ঢাকার বাইরে সফল হলেও ব্যর্থ হয়েছেন ঢাকার নেতারা। বিশেষ করে গত বছরের ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশ পথে অবস্থান কর্মসূচি এবং ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পরই রাজপথের লড়াই থেকে পিছিয়ে যায় দলটি। পরবর্তীতে নির্বাচন বর্জন করে যে আন্দোলন চলমান ছিল সেখানেও অনেক শীর্ষ নেতাই ছিলেন নিষ্ক্রিয় এবং অনুপস্থিত।
এর মধ্যে ২৯ জুলাইয়ের অবস্থান কর্মসূচিসহ সব কর্মসূচি এগিয়ে নেন তিনি। পরে ২ নভেম্বর আটক হন আমিনুল হক। অন্যদিকে আমান উল্লাহ আমান ২৯ জুলাই গাবতলীতে কর্মসূচি পালনে ব্যর্থ হওয়া, নেতাকর্মী আহত হওয়াসহ সব ব্যর্থতার জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। এছাড়া পরবর্তীতেও মহানগর উত্তরে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করা এবং তাদের রাজপথে সক্রিয় রাখতেও তিনি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলে দলের হাইকমান্ডের কাছে অভিযোগ করা হয়। ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপিতে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রফেসর ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়।
তবে তিনি পেশাজীবী হিসেবে সফলতার পরিচয় দিলেও মাঠের রাজনীতিতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছিলেন না বলে দলের নেতাকর্মীরা জানান। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবও ২৯ জুলাইয়ের অবস্থান কর্মসূচি পালনে ব্যর্থ হন এবং ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচিতেও তারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেননি বলে দলটির অভিযোগ। এছাড়া সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু কারাবন্দী হলেও সমাবেশের গরম বক্তা আহ্বায়ক আব্দুস সালামকে রহস্যজনক নিষ্ক্রিয় দেখা যায়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগর এবং বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর দীর্ঘদিনেও তারা কাউন্সিল করতে পারেনি। বরিশাল মহানগরের নেতারা কর্মসূচি পালনেও ব্যর্থ ছিলেন।
বিএনপি ও যুবদল সূত্রে জানা যায়, সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না দীর্ঘদিন কারাবন্দী ছিলেন। আন্দোলনের সময় দায়িত্বে ছিল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন। এর মধ্যে ২৯ জুলাই মিল্টনকে উত্তরায় দায়িত্ব দেয়া হলেও সে দিন তিনি নির্ধারিত স্থানে না গিয়ে অন্য স্থানে অবস্থান নেন। বিএনপির উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হকসহ নেতাকর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে তাকে ডেকেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
আর সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু সে দিন শনিরআখড়া এলাকায় পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড় দিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি করেন। হঠাৎ করে বিএনপির বেশ কিছু কমিটি বিলুপ্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, হঠাৎ করে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে এমন নয়। এটা দলের চলমান প্রক্রিয়া। দলের নিয়মিত সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কখনো কমিটি গঠন করা হয়, আবার কখনো বিলুপ্ত করা হয়। এটা খুব স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।