তৌফিক ইসলাম ও মজিবুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে ‘অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক’ কোটা বাতিলের একদফা দাবিতে আন্দোলন চলছে। দাবি আদায়ে তৃতীয় দিনের মতো রাজধানীসহ সাড়া দেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা।

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সারাদেশে চালিয়ে যাচ্ছেন এ কর্মসূচি। গতকাল বুধবার সকাল ১০টা থেকে রাস্তায় নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই।

সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর একমাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রটি বহাল থাকছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। গতকাল বুধবার দুপুরে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন জানান, আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিয়েছেন। ফলে যা ছিল, তা-ই থাকবে। অর্থাৎ, কোটা বাতিল নিয়ে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল থাকছে।

কোটা নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতিবস্থার আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বলেন, প্রতিবাদকারীরা চাইলে আদালতে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে ভিসিদেরও উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বুধবার বেলা ১০টার দিকে তারা রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করতে শুরু করেন। বিকাল নাগাদ রাজপথের অন্তত ২০টি স্থান তারা অবরুদ্ধ করেছেন। এর ফলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে কার্যত স্থবির হয়ে গেছে পুরো রাজধানী। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ ব্লক করেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। বিভিন্ন সড়কে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন লাখো মানুষ। বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজিবী ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ চরমে। রাস্তায় কোনও যানবাহন চলাচল করতে না পারায় শিশু, নারী ও বৃদ্ধসহ সবাই পায়ে হেঁটেই চলাচল করছেন।

কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সকালে প্রথমে রাজধানীর শাহবাগ ও সায়েন্সল্যাব মোড় ব্লক করেন। পরে একে একে কাঁটাবন, নীলক্ষেত, ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলামোটর, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, বিজয়স্মরণী, মহাখালী, চানখারপুল, বঙ্গবাজার, শিক্ষা চত্বর, মৎস্য ভবন, জিপিও, গুলিস্তান, রামপুরা ব্রিজ, আগারগাঁও, হাতিরঝিলের মোড়ে ও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারসহ ২০টির বেশির গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে ‘ব্লকেড’ তৈরি করে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেওয়রের ফ্লাইওভার ও মগবাজার-সাতরাস্তা ফ্লাইওভারও ব্লক করে দেন আন্দোলনকারীরা। এছাড়াও মহাখালী ও কারওয়া বাজার রেল ক্রসিংয়ে কাঠের গুঁড়ি ফেলে রেলপথ ব্লক করেছেন তারা। এতে ঢাকার সঙ্গে সাড়া দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ রাস্তায় যানবাহন আটকে আছে। কোনও দিকেই যাওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতি নেই। গাড়ি নিয়ে বিপাকে পড়েন চালকরা। বাসের যাত্রীরা নেমে হাঁটা শুরু করলেও তারা গাড়ি রেখে কোথাও যেতেও পারছেন।
মহাখালী এলাকায় এক ভুক্তভোগী ফাহিমুর আলম বলেন, এটা কেমন কথা, কোনও কিছু হলেই রাস্তা ব্লক। আন্দোলন মানে জনদুর্ভোগ। আমার চলাচলে নানা সমস্যা। এভাবে তো চলতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হবে। কোনও যানবাহন চলবে না।

এদিকে দেখা যায়, যানবাহন চলাচল করতে না পারায় হাজার হাজার মানুষ পায়ে হেঁটে চলাচল করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যাল হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে মহাখালি বাসায় ফিরছিলেন শফিক মধ্যবয়সী এক রোগী। তিনি বলেন, ডাক্তার দেখানোর পর বাসায় যাওয়ার জন্য কোনও গাড়ি পাচ্ছি না। কোনও রিকশাও চলছে না। কিছুদূর হেঁটে আসলাম। এখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। বাকি পথও হেঁটে যেতে হবে।

কাওরানবাজার এলাকায় কথা হয় কোটা আন্দোলনের সেন্ট্রাল ভলান্টিয়ার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নিহাল মোহাম্মদ আসিফের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি। আমার দাবি আদায়ে রাস্তা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করছি। এতে সাধারণ মানুষের সাময়িক দুর্ভোগ হলেও গোটা জাতির স্বার্থে তারা এটা মেনে নিচ্ছেন।

অনেক সাধারণ মানুষ আমাদের আন্দোলনে এসে যোগ দিচ্ছেন। তারা আমাদের যৌক্তিত আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে সাময়িক দুর্ভোগ মেনে নিচ্ছেন। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই আমাদের দাবি মেনে নিন। দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

এদিকে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করেছেন আপিল বিভাগ। পৃথক দুটি আবেদনের পর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ বুধবার এ স্থিতাবস্থা জারি করেন। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করে দেশজুড়ে চলমান ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

আপিল বিভাগের আদেশের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আদালতের সঙ্গে আমাদের আজকের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা মূলত নির্বাহী বিভাগের কাছেই কোটা-সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান চাইছি। এক দফা দাবি। এটি আদালতের এখতিয়ার নয়। এটি একমাত্র নির্বাহী বিভাগই পূরণ করতে পারবে। সরকারের কাছ থেকেই আমরা সুস্পষ্ট বক্তব্য আশা করছি।