সরকারকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখতে এবার ভিন্ন কৌশলে বিএনপি
আলমগীর হোসেন ও শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: হঠাৎ বিএনপির ‘জাতীয় ঐক্য’র আহ্বান নিয়ে নানা মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে দেশের চলমান পরিস্থিতিকে ক্রান্তিকাল হিসাবে দেখছে বিএনপি। এজন্য এখনই জাতীয় ঐক্য গঠনের উপযুক্ত সময় হিসাবে মনে করছে দলটি। সরকার পতনের একদফা দাবিতে বিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছেন তারা। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো হঠাৎ চাপের মুখে পড়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের পর দলগুলো যখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখন এই আন্দোলন দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে। সংষর্ষ-সহিংসতার অভিযোগে দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আবারো চিরুনি অভিযান শুরু করেছে।
বিএনপি’র একাধিক নেতারা বলছেন, কোটা সংস্কার নিয়ে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে সেখানে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল। একই সাথে সরকার যে উপায়ে আন্দোলন দমন করেছে, তাতে জনমনে একধরনের ক্ষোভও তৈরি হয়েছে।
তা ছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল এবং একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দল হিসেবে বিএনপির কিছু করণীয় আছে। সে জন্য সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আলোচনাসাপেক্ষে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয় তারা।
তা ছাড়া বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাদের এক দফার আন্দোলনকে আরো জোরদার করার সময় এসেছে এবং সেটি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তবে বিএনপির ‘জাতীয় ঐক্য’র আহ্বান নিয়ে সব মহলে চলছে নানা আলোচনা।
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ৩৯ দল ছাড়াও ইসলামী, বাম ও ডানপন্থি আরও ১৫টি দলের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রথমে সব দল মিলে একটি যৌথ বিবৃতি দিতে পারে। পরে অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামার কথা ভাবছে বিএনপি। তবে এই ঐক্যের আহ্বান নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে কয়েকটি দলের। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যের বিষয়ে বামপন্থি কয়েকটি দল আরও সময় নিতে চাইছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে এসব তথ্য।
বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ঐক্য হয়েই আছে। বৃহত্তর পরিসরে এ ঐক্য গঠনে আগে থেকেই কাজ চলছে। এরমধ্যে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও উদ্ভূত পরিস্থিতি ঐক্য গঠনের সঠিক সময় হিসাবে মনে হয়েছে। এর কারণ হিসাবে নেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে এবং তারা মাঠেও ছিলেন।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়ে সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এ আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে। নেতারা মনে করেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী নামানোর অর্থ হচ্ছে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখন আবার বিরোধীদের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত গণতান্ত্রিক দেশের সরকারই সব বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়। দেশের স্বার্থে এটাই হওয়া উচিত।
কিন্তু সরকার তা না করে বিরোধীদের ধরপাকড়সহ নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। এই ক্রান্তিকালে সরকার যেহেতু জাতীয় ঐক্যের কথা ভাবছে না, তাই বড় রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির দায়িত্ব থেকে ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়েছে। নেতারা আশা করছেন, দেশের স্বার্থে এই আহ্বানে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল সাড়া দেবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘বর্তমান সংকট সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠা। দেশকে রক্ষার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। এজন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়া হয়েছে। আর একদফা দাবিতে জাতীয় ঐক্য তো হয়েই আছে। এখন ঐক্য নিয়ে কাজ করার ব্যাপার। এখানে বিএনপির দলীয় কোনো স্বার্থ নেই। দেশকে বাঁচানো ও জনগণকে রক্ষার স্বার্থে কাউকে না কাউকে ঐক্যের ডাক দিতে হবে, জনগণের দল হিসাবে বিএনপি সেই জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। আশা করি বিরোধী সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে জবাবদিহির সরকার প্রতিষ্ঠা করবে।
বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, এ মুহূর্তে রাজপথে কোনো কর্মসূচি পালনের সুযোগ সরকার দেবে না। তবে সঙ্কটজনক এমন সময়ে তাদের নীরব বসে থাকলেও চলবে না। জাতীয় ঐক্যের ডাকে সাড়া দেয়া দলগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে শিগগিরই সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর যৌথ বিবৃতি দেয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য রয়েছে, আন্তর্জাতিক বিশ্বকে সেই বার্তা দিতে চায় বিএনপি। একই সাথে সঙ্কট উত্তরণে রাজনৈতিকভাবে করণীয় পথ বের করারও চেষ্টা করা হবে।