বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতের পদত্যাগ, স্বস্তিতে বিনিয়োগকারীরা
শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটে অবশেষে পদত্যাগ করলেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রকসংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবর শনিবার তিনি ইমেইলে পদত্যাগপত্র পাঠান। শিবলী রুবাইয়াত দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতের পদত্যাগে স্বস্তি প্রকাশ করছেন বিনিয়োগকারী সহ বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তবে পদত্যাগ না করলে তাকে অপসারণের বিষয়টি আগেই সরকারের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে অন্যান্য কমিশনারদের ব্যাপারেও। ইতোমধ্যে প্রাথমিক বার্তা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিএসইসিকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এর ফলে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়ার আড়াই মাসের মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে কমিশন। এর আগে শুক্রবার রাতে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। গত ২৮ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বিরোধীতা সত্যেও চলতি বছরের ২৮ মে তাকে ৪ বছরের জন্য পুনঃনিয়োগ দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ২০২০ সালের ১৭ মে তাকে প্রথমবার বিএসইসির চেয়ারম্যান করা হয়।
প্রথম মেয়াদের নিয়োগে নানাভাবে বির্তকিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের এই অধ্যাপক। আলোচ্য সময়ে বিভিন্ন অপরাধ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বেপরোয়া ছিলেন তিনি। পুঁজিবাজারে কারসাজিসহ থেকে বিভিন্ন ধরণের সুবিধা নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে গড়েন সম্পদের পাহাড়। অপরাধের জন্য কারসাজির চক্রকে সঙ্গে নিয়ে বিশাল অসাধু সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটে কমিশনের ভেতরের কর্মকর্তা, স্টক এক্সচেঞ্জের পর্ষদের সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গ্যাম্বলার, ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী আমলা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থমন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং গণমাধ্যমের লোকজনও রয়েছেন।
এদিকে বর্তমান কমিশনের নানা অনিয়ম থেকেও বাজার বের হয়ে আসবে এমন আশাও রয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান এবং কমিশনারদের কয়েকজন ৫ আগস্টের পর আর অফিসে আসছেন না।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত তিন কর্মদিবসে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক বেড়েছে ৬৯৫ পয়েন্ট। এর মধ্যে আগের দুই দিন মঙ্গলবার ও বুধবার ডিএসইর সূচক বেড়েছে যথাক্রমে ১৯৭ এবং ১৯৩ পয়েন্ট। অর্থাৎ দুই দিনে মোট ৩৯০ পয়েন্ট বেড়েছে। আর বৃহস্পতিবার এক দিনেই বেড়েছে ৩০৬ পয়েন্ট। এদিন ডিএসইতে এক হাজার ৬০৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৭৭৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে লেনদেন বেড়েছে ৮৩০ কোটি ৯১ লাখ বা ১০৭ শতাংশ। এদিকে দেশে অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের খবরে গত তিন দিনে ডিএসইর সূচক বেড়েছে ৬৯৩ পয়েন্ট। এটি বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। এর আগে এই রকম টানা তিন দিনের উত্থানে ডিএসই সূচকের এমন উত্থান হয়নি।
জানা গেছে, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠনের খবরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ড. ইউনূসের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর আস্থার কারণেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এমন আস্থার ভিত তৈরি হয়েছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তবে পুঁজিবাজারে সূচকের বড় উত্থানে চলতি সপ্তাহে এক দিনও অফিস করেননি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। সদ্য ক্ষমতা থেকে বিতারিত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন শিবলী রুবাইয়াত জনরোষের ভয়ে অফিস করছেন না বলে জানা গেছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামও ভয়ে আছেন। তার মেয়াদে পুঁজিবাজারে ব্যাপক লুটতরাজ হয়েছে। তার যোগসাজশে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। বিভিন্ন পর্ষদ পুনর্গঠনের নামে বিভিন্ন কোম্পানিতে নিজের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের পরিচালক হিসেবে বসিয়ে লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া; ব্যবসা না করতে পেরে বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানিকে নিজের লোকদের হাতে তুলে দিয়ে সেগুলোকে পুনরায় বাজারে নিয়ে এসে বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দেন তিনি।
তার বিরুদ্ধে টাকা পাচার এবং পাচারকারীদের সহায়তা করারও অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে কমিশনের পুনর্গঠন চেয়েছেন খোদ সংস্থাটির কর্মকর্তারা। গত মঙ্গলবার বিএসইসি অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান।
সভায় বিএসইসির কর্মকর্তারা শেয়ারবাজারের অধ্যাদেশ, আইন ও বিধিবিধানের বাইরে কোনো সুপারিশ বা কোনো ধরনের কাজ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এছাড়া বুধবারও বিএসইসির কর্মকর্তারা এসব বিষয় নিয়ে বেশ সরব ছিলেন। এই সময় তাদের পক্ষ থেকে বেশকিছু দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে কমিশনের অভিজ্ঞ সিনিয়র কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদে নিয়োগ দিতে হবে।
দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে জানা গেছে- খেলাপি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ২০২০ সালে বিএসইসিতে যোগদান করেন শিবলী রুবাইয়াত। এখানে আসার পর তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল অভিনব পদ্ধতিতে দুর্বল কোম্পানির পর্ষদ ভেঙ্গে কোম্পানি দখল। তার সময়ে তিন বছরে এভাবে ২৬টি কোম্পানির মালিকানা বদল হয়েছে। অপরাধীদের আশ্রয় স্থল হয়ে উঠেন তিনি।
বিএসইসির জনবল নিয়োগ পদোন্নতিতে জালিয়াতি, দুর্নীতিগ্রস্ত কোম্পানির আগের মামলা বাতিল করে দিয়ে তাদেরকে অব্যাহতি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কোম্পানির আগের মামলা বাতিল করে দিয়ে তাদেরকে দায়মুক্তি দিয়েছেন তিনি। বিশাল সংখ্যক জনবল নিয়োগে জালিয়াতি ও আইনলংঘন করে পদোন্নতির ঘটনায় তাকে সহায়তা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ এবং বাংলাদেশ ইন্সষ্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের নির্বাহী চেয়ারম্যান মোহাম্মদ তারেক।
আর জনবল নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের সদস্য ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম। এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সংস্থা সরকারের কাছে রিপোর্ট পাঠালেও ওই সময়ে রহস্যজনক কারণে তা আমলে নেয়নি অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগসহ সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।